জয়পুরহাটে গুলিতে নিহত বিজিবি সদস্য নেপাল দাসের (৩৫) শেষকৃত্য তার নিজ বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার মেগচামি ইউনিয়নের কলাগাছি গ্রামের পারিবারিক শ্মশানে সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল শুক্রবার (১৯ নভেম্বর) রাত সাড়ে ৯টার দিকে শেষকৃত্য শুরু হয়। শেষ হয় রাত দেড়টার দিকে।
ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার মেগচামী ইউনিয়নের কলাগাছি দাসপাড়া গ্রামের নারায়ণ চন্দ্র দাস ও কানন বালা দাস দম্পতির ছেলে নেপাল দাস। এক বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে নেপাল ছিল মেজো। বোন হাসিরাণী দাস বিবাহিত। বড় ভাই গোপাল দাস ব্র্যাক ব্যাংকে ও ছোট ভাই বাদল দাস সেনাবাহিনীতে কর্মরত।
শনিবার (১৯ নভেম্বর) দুপুরে নেপাল দাসের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাবা-মা, ভাই-বোন ও স্বজনরা কাঁদছেন। নেপালের আকস্মিক মৃত্যুতে হতভম্ব হয়ে পড়েছেন তারা।
নেপালের মা কানন বালা দাস (৫৯) আহাজারি করতে করতে বলেন, আমার সন্তান হারাই গেল। তাজা প্রাণ ঝড়ে গেল, মা হইয়া এই দৃশ্য আমি কেমনে সইব? এমন ঘটনা যেন কোনো স্ত্রী বা কোনো সন্তানের বাবা-মায়ের জীবনে না আসে। চোখের সামনে সন্তানের দাহ দেখার চেয়ে যন্ত্রণার দৃশ্য এই জগতে আর কী হতে পারে?
এর আগে বৃহস্পতিবার (১৭ নভেম্বর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে নেপাল দাসকে জয়পুরহাট আধুনিক হাসপাতালে বিজিবির পোশাক পরা ও বুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় জরুরি বিভাগে আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে ওই হাসপাতালে তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ময়নাতদন্তের পর শুক্রবার দুপুরে বিজিবি-২০ জয়পুরহাট ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক রফিকুল ইসলাম মরদেহটি নেপালের বড় ভাই গোপাল দাসের হাতে তুলে দেন।
গোপাল দাস বলেন, আমাকে বিজিবি থেকে জানানো হয়- পাঁচবিবি উপজেলায় একটি ক্যাম্পে কর্মরত ছিলেন নেপাল। রাত ১০টার দিকে দুটি গুলির শব্দ শুনতে পেয়ে ক্যাম্পের লোকজন দেখতে পান নেপাল গুলিবিদ্ধ। ওই ক্যাম্পে যারা কর্মরত ছিলেন তাদের মধ্যে থেকে একজন সৈনিককেও পাওয়া যাচ্ছে না। কীভাবে কী ঘটনা ঘটেছে তা তদন্ত করছে বিজিবি। তদন্ত শেষে জানা যাবে ওই সময় কি ঘটেছিল।
তিনি জানান, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে মেগচামী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাব্বির উদ্দীন শেখ তাকে এ মৃত্যুর ঘটনা জানান। চেয়ারম্যান জানান, তাকে বিজিবি জয়পুরহাট থেকে ফোন করে তার পরিবারকে বিষয়টি জানাতে বলা হয়েছে। পরে শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে নেপালের মরদেহ নিয়ে দাসপাড়া গ্রামের বাড়িতে পৌঁছান তারা।
নেপালের প্রতিবেশী স্কুলশিক্ষক বিশ্বজিৎ দাস (৩৬) বলেন, গতকাল রাতে নেপালের মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসলে এক বেদনা বিধুর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। রাতে দাহ করা হয়। গ্রামের মানুষের চোখের জলে তাকে বিদায় দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, নেপালের মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসার পর সেটি দাহ করা হবে নাকি ময়নাতদন্ত করা হবে এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে ছিলেন পরিবারের সদস্যরা। খবর পেয়ে মধুখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহীদুল ইসলাম ঘটনাস্থলে আসেন।
ওসি শহীদুল ইসলাম বলেন, নেপালের মরদেহ জয়পুরহাট হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে জয়পুরহাট সদর থানায়। বিজিবির পাশাপাশি পুলিশও বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে। এ অবস্থায় ফরিদপুরে আইনগত কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ নেই।
নেপালের বাবা নারায়ণ চন্দ্র দাস (৬৯) বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে ছেলের সাথে তার পুত্রবধূ অঞ্জনার মুঠোফোনে সর্বশেষ কথা হয়। স্ত্রীকে বলেছিল, ‘আমি এখন ডিউটিতে যাচ্ছি।’ এরপর আমার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলা হলো। কীভাবে বাঁচবে নেপালের স্ত্রী অঞ্জনা। কী অবস্থা হবে নেপালের সন্তান অর্ণবের। চার বছরের অর্ণব সাদা গেরুয়া পড়ে তার বাবার মৃত্যুর পর যে ধর্মীয় বিধান থাকে সেটি পালন করছে। ও হয়তো বুঝতেছেও না বাবাকে হারিয়েছে, জীবনের সেরা সম্পদ হারিয়েছে।
নেপালের দাদি অশীতিপর বৃদ্ধ রেনু বালা দাস বলেন, প্রতিবার ছুটিতে আইসা আমার নাতি আমারে ওষুধ কিনা দিয়া যাইত। যাওয়ার পর মোবাইলে খবর নিত ওষুধ খাইছি কিনা। আমার নাতিরে মানুষে মাইরা ফালাইছে- বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
পরিবারের সদস্যরা জানান, নেপাল উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে মধুখালীর সরকারি আয়েনউদ্দিন কলেজ থেকে। ২০১২ সালের ২২ এপ্রিল তিনি বিজিবির সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। ২০১৬ সালে তিনি অঞ্জনা দাসকে বিয়ে করেন। তার চার বছর বয়সী অর্ণব দাস নামে একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। তিনি বিজিবি-২০ জয়পুরহাট ব্যাটালিয়নে সৈনিক পদে কর্মরত ছিলেন।
মধুখালীর মেগচামী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাব্বির উদ্দীন শেখ বলেন, নেপালের এই আকস্মিক মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। আমি ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম। সব শোকের তো আর সান্ত্বনা হয় না। ওর বাবা-মা-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছি। ওই এলাকায় এখন শোকের ছাঁয়া বিরাজ করছে। ওর ছোট একটি বাচ্চা পিতাহারা হলো। বিষয়টি হৃদয়বিদারক। আমি এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই।