টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এশিয়াখ্যাত দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার ১২৬তম জন্মজয়ন্তী উদ্যাপিত হয়েছে। শুক্রবার (১৮ নভেম্বর) কুমুদিনী কমপ্লেক্সে ভারতেশ্বরী হোমসের মাঠে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। একই সঙ্গে কুমুদিনী কল্যাণ সংস্থার ৯১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানও হয়।
অনুষ্ঠান দুটি ঘিরে শুক্রবার সকাল থেকেই পুরো কুমুদিনী চত্বর আনন্দ আয়োজনে মুখর হয়ে ওঠে।
অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দুপুরের পর থেকেই দেশি-বিদেশি অতিথিরা কুমুদিনী চত্বরে আসতে থাকেন। অতিথিদের মধ্যে সাংসদ আরমা দত্ত, টাঙ্গাইল-৭ মির্জাপুর আসনের সাংসদ খান আহমেদ শুভ, টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাবেক সাংসদ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুক, ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা, অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার জেরেমি ব্রুর, ভুটানের রাষ্ট্রদূত রিনচেন কুয়েনতসি, নেপালের রাষ্ট্রদূত গনশেম ভান্ডারি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের নেতৃত্বে বিচারপতি রুহুল কদ্দুস ও মো. ইকবাল কবির, টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার, কুমুদিনী কল্যাণ সংস্থার পরিচালক (শিক্ষা) প্রতিভা মুৎসুদ্দি ও পরিচালক প্রীমতী সাহা, শম্পা সাহা, ভারতেশ্বরী হোমসের অধ্যক্ষ ত্রয়ী বড়ুয়া, কুমুদিনী উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. এম এ হালিম, কুমুদিনী হাসপাতালের পরিচালক প্রদীপ কুমার রায়, মির্জাপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আমিনুল ইসলাম বুলবুল, থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ আবু সালেহ মাসুদ করিম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় সন্ধা সাড়ে ৫টায় ভারতেশ্বরী হোমসের মাঠে। এ সময় ভারতেশ্বরী হোমসের শিক্ষার্থীরা শারীরিক কসরত প্রদর্শন করে। এর মাধ্যমে তুলে ধরা হয় বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নৃত্য।
১৯৩৮ সালে শোভাসুন্দরী ডিসপেনসারি ও ভারতেশ্বরী বিদ্যাপীঠ দিয়ে রণদা প্রসাদ সাহা তাঁর জনহিতকর কাজ শুরু করেন। তখন পুরোটাই তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি ছিল। ১৯৪৭ সালে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন। পুরো সম্পত্তি ট্রাস্টে দান করে দেন। পরে কুমুদিনী কল্যাণ সংস্থার পক্ষ থেকে অতিথিদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজীব প্রসাদ সাহা।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ৯১ বছর আগে কুমুদিনী কল্যাণ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, যা উপমহাদেশে নানা ভালো পরিবর্তনে সহযোগিতা করেছে। ১৯৭১ সালে তাঁকে ও আমার বাবা ভবানী প্রসাদ সাহাকে পাকিস্তানি হানাদারেরা ধরে নিয়ে যায়। ওই সময় তাঁদের সঙ্গে এই এলাকার অন্তত ৬০ জন মানুষকে আমরা হারিয়েছি। রণদার মৃত্যুর পর তাঁর রেখে যাওয়া স্থাপনা হারায়নি। আজও সগৌরবে দাঁড়িয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। ’
এরপর পুরো চত্বরে থাকা বিদ্যুতের আলো হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। ভারতেশ্বরী হোমসের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক কবি ও সাহিত্যিক হেনা সুলতানার সঞ্চালনায় শিক্ষার্থীরা ‘ও আলোর পথের যাত্রী’, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’সহ কয়েকটি গানের সঙ্গে মোমবাতি প্রজ্বালন করে রণদার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এ সময় অতিথিরা এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।
টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাবেক সাংসদ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুক বলেন, ‘রণদা প্রসাদ সাহা আমাদের সমাজ ও দেশকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছেন। তিনি নারী অধিকার, শিশুদের শিক্ষার অধিকারের জন্য যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। যেখান থেকে আমরা নিজেরা অনুপ্রাণিত হয়ে যে যেটুকু পারি, সেটুকুই সমাজের জন্য উপহার দিয়ে ভালো কিছু করতে পারি। ’
অনুষ্ঠানের অতিথি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আসলে ওনার মতো এরকম প্রতিভা খুব কম লোকেরই আছে। বাংলাদেশে একজন মানুষের দ্বারা এতো মানুষ উপকৃত হতে পারেন তা আমার জানা ছিলো না। যেমন ডাক্তার, নার্স, রোগী ও গরীব মানুষসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে যেভাবে সেবা দিয়েছেন এটি সত্যিই প্রশংসনীয়। ওনার মতো স্যাক্রিফাইস মাইন্ডের মানুষ আরও হওয়া দরকার। সব সেক্টরেই ওনার সেবা প্রশংসনীয়। হাজী মোহাম্মদ মহসীনের নাম আমরা একবার শুনেছিলাম। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে বঙ্গবন্ধুর দ্বারা। আর টাঙ্গাইলকে সমৃদ্ধ করেছে মানুষকে সাহায্য করেছে রণদা। ’
১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর দেবেন্দ্রনাথ পোদ্দার ও কুমুদিনী দেবীর দ্বিতীয় পুত্র রণদা সাভারের মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে ওঠেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। ১৯৩৮ সালে শোভাসুন্দরী ডিসপেনসারি ও ভারতেশ্বরী বিদ্যাপীঠ দিয়ে তাঁর জনহিতকর কাজ শুরু করেন। তখন পুরোটাই তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি ছিল। ১৯৪৭ সালে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন। পুরো সম্পত্তি ট্রাস্টে দান করে দেন। পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের (১৯৪৩) সময় তিনি সারা দেশে প্রায় ৩০০টির মতো লঙ্গরখানা খুলে কয়েক মাস নিজ অর্থে বুভুক্ষু মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। এ জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রায় বাহাদুর’ খেতাব প্রদান করে।
দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও তাঁর ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে ১৯৭১ সালের ৭ মে নারায়ণগঞ্জের কুমুদিনী কমপ্লেক্স থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা ধরে নিয়ে যায়। আর ফিরে আসেননি তাঁরা।