সন্ধ্যার আলো তখন প্রায় শেষ। মহিপালে তখন হোটেল সমূহের আলো ছড়ায়। মৃদু লাইট সমূহ জ্বল জ্বল করে জ্বলতেই কারুকাজ করা বোরকা পরা কয়েকজন রমনী ও মধ্যবয়স্ক নারীকে দেখা যায়। সাজগোছ ও হাবভাবে মনে হয় কোন কোটিপতির স্ত্রী দাড়িয়ে আছে তার স্বামী তাকে নিবে বলে। কিন্তু না এরা মূলত খদ্দের যাচাই-বাছাই করছেন টাকার বিনিময়ে। সন্ধ্যা নামার পরপরই মহিপাল শহর এখন পতিতাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল। পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে ও এখন এই পতিতা-দের নিয়ে চলছে ব্ল্যাকমেইলিং করে চাঁদা দাবি করা সহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফেনীর প্রতিটা উপজেলা শহরে অবাধে চলছে রমরমা পতিতা বৃত্তি। আর এই পতিতা কারবারীদের টার্গেট থাকে উঠতি বয়সী যুবকদের দিকে। ফেনী শহরে বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী গনিকা সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট দ্বারা পরিচালিত পতিতা কারবারের ক্ষেত্র ফেনীতে অনেকটাই নিরাপদ। যারা আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের সাথে মিলেমিশে সিন্ডিকেট ওয়ালারা অবাধে চালাচ্ছে এই নিষিদ্ধ কারবার।
ফলে স্থানীয় চাহিদার যোগান দিতে এই কারবারীরা অনেকটাই হিমশিম খাচ্ছে। ফলে অন্যান্য জেলা থেকে পতিতা আমদানী করে স্থানীয় চাহিদা মিটানো হচ্ছে। এজন্য জেলা শহর ফেনীতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে গনিকার আনাগোনা। বিপুল পরিমাণ গনিকার যোগান দিতে এখানে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বহিরাগত গনিকা বা ভিজিটিং কলগার্ল।
ফেনী শহর ছাড়াও উপজেলা পর্যায়ও গনিকাদের দৌরাত্ম্যে বাড়ছে। পাশাপাশি চলছে নিষিদ্ধ মাদক। মাদক আর নারী দু’টা মিলিয়ে যুবসমাজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। শহরের শহীদ শহিদুল্লা কায়সার সড়ক, পাঠান বাড়ি সড়ক, আলকেমি হাসপাতাল ও সড়কসহ আশেপাশের হোটেল ও বাসাবাড়িতে চলছে জুয়া ও গনিকার রমরমা কারবার।
জনবহুল মহিপাল ফ্লাইওভারের নীচে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে জমে ওঠে গনিকা বাজার। বিকিকিনি শেষে পাশের হোটেল ঘন্টা চুক্তিতে সময় কাটায় এরা। ফেনী মডেল থানার আওতায় শহীদ শহিদুল্লা কায়সার সড়কে রয়েছে শহর পুলিশ ফাঁড়ি। শহরের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা এটি। এখানে রয়েছে বিপুল পরিমাণ মার্কেট ও আশপাশে সব আবাসিক এলাকা। বর্তমান সরকারের সময় এই এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড খুব একটা চোখে পড়েনা। এই নিরিবিলি অবস্থার সুযোগ নিয়ে আদিম কারবারীরা নিজেদের ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছে অভিনব কায়দায়।
আবাসিক হোটেলে রুম নিতে হলে কিছু নিয়ম-কানুন রয়েছে। কিন্তু ফেনীর টু-নাইনটি হোটেল গুলোতে সরকারী নিয়ম-কানুনের বালাই নাই। এখানে রুম ভাড়া দেওয়া হয় ঘন্টা চুক্তিতে। ন্যাশনাল আইডি, লাগেজপত্র, স্থায়ী ঠিকানা ও বর্তমান ঠিকানা মূল রেজিস্টারে এন্ট্রি করা হয়না। এতে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। ভ্যাট ফাঁকি দিতে হোটেল ব্যবসায়ীরা মূল রেজিষ্ট্রার ছাড়াও ছটি রেজিস্ট্রারে বোর্ডারের নাম ঠিকানা এন্ট্রি করে রাখে।
কোন রকম বিপদের সংকেত ফেলেই তারা মূল রেজিস্ট্রারে এসব বোর্ডারের নাম এন্ট্রি করে পার পাওয়ার চেষ্টা করেন। এন্ট্রি করা বোর্ডারদের বিস্তারিত লোকাল থানাকে অবহিত করার নিয়ম থাকলেও তার তোয়াক্কা করেনা, ফেনীর আবাসিক হোটেল মালিক পক্ষ। কাস্টমসের অসাধু কর্মকর্তারা এসব হোটেল থেকে উৎকোচ গ্রহন করার অভিযোগ পুরোনো।
শহীদ শহিদুল্লা কায়সার সড়কের মাঝামাঝি উত্তর পাশে রয়েছে স্টার ভিউ আবাসিক হোটেল। হোটেলটির সামনে একটি সিঁড়ি ও পিছনে পরিকল্পিতভাবে আরেকটি সিঁড়ি রাখা হয়েছে। মূলত এই হোটেলে রাত্রি যাপন করতে খুব একটা বোর্ডার আসেনা। তাদের আসল কারবার গনিকা বাণিজ্য। হোটেলের ভিতরে স্টোর রুমে ৪/৫ জন সুন্দরী তরুণীকে রাখা হয়। মোবাইলে কথাবার্তা ফাইনাল করে পিছনের সিড়িঁ দিয়ে খদ্দের প্রবেশ করে। ফলে কেউ বুঝতেও পারেনা এখানে কি হচ্ছে।
জানা যায়, হোটেলটি চালায় টিটো ও মিঠু নামের দু’ভাই। ফেনী শহরের স্ট্রেশন রোডে ইদ্রিছিয়া হোটেলটিও তারা চালায়। এছাড়াও ভিআইপি খদ্দেরের জন্য টিটো-মিঠু সিন্ডিকেট শহরে আরো দু’টো বাসা নিয়ে দেদারচ্ছে গনিকা কারবারে মত্ত আছে। তাদের পিতাও হোটেল ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলো। পৈতৃক ব্যবসায় এদের লাজ-লর্জা নাই। এদের রয়েছে শক্তিশালী দালাল সিন্ডিকেট। এসব যুবতীর মধ্যে বেশীর ভাগই হচ্ছে প্রবাসীর স্ত্রী। স্কুল কলেজের উঠতি বয়সী মেয়েরাও এই পথে পা বাড়িয়েছে। এরা দীর্ঘদিন যাবত শহরের বিভিন্ন স্থানের আবাসিক হোটেল ছাড়াও গণবসতিপূর্ণ এলাকাগুলিতে দাপটের সাথে কারবার চালিয়ে আসছে।
কয়েকজন পতিতার সাথে কথা বলে জানা যায়, অনেকেই প্রতারিত হয়ে এই ব্যবসায় আসতে বাধ্য হয়েছেন। প্রতারক চক্র প্রেমিক সেজে প্রথমে দৈহিক মিলনে বাধ্য করে ভিডিও ধারণ করে পরে ব্লাক মেইলিং শুরু করে। এরপর ওই ভিডিওর ভয় দেখিয়ে নিয়মিত প্রতারনা করে থাকে। এভাবে ব্লাক মেইলের মাধ্যমে এই পেশায় পা বাড়ায় নতুন পতিতারা। আবার প্রবাসীর স্ত্রীরা স্বামীকে ভুল বুঝিয়ে শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। ছেলে মেয়েদের মানুষ করার বুলি নিয়ে শহরে এসে তারা অবৈধ পথে পা বাড়ায়। আবার কেউ কেউ করোনার কারণে আর্থিক অনটনে পড়েও অবৈধ এ পেশায় নিজেকে জড়িয়েছেন।
দালাল চক্র মেয়েদের মাধ্যমে ফোনে প্রেমালাপ করিয়ে কৌশলে ছেলেদের নিজস্ব বাসায় ডেকে নেয়। এরপর মেয়েদের পাশে বসিয়ে নগ্ন ছবি ও ভিডিও ধারণ করে জিম্মি করে থাকে। পরে ফাঁদে ফেলে কাঙ্খিত ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা, মোবাইল ও মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নেয়। অনেক সময় টাকার পরিমান কম থাকলে বিকাশের মাধ্যমে টাকা আদায় করে থাকে এ প্রতারক চক্র। এধরনের ঘটনায় অনেকে আক্রান্ত হলেও লাজ লজ্জার ভয়ে কেউ মুখ মুলে প্রতিবাদ অথবা আইনের আশ্রয় নিতে চায়না। এ ধরনের ঘটনা ফেনীতে অহরহ ঘটলেও কোন প্রতিকার নেই।
তবে অভিযোগের সবটুকুই অস্বীকার করে ফেনীর শহরের শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়কের স্টারভিউ আবাসিক হোটেলের সত্বাধিকারী ও কালিদহ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফরিদ আহাম্মদ টিটু জানান, আমার এখানে পতিতা ব্যবসা হয়না। সবগুলো নিয়ম মেনেই আমি হোটেল ব্যবসা করে আসছি।
এই বিষয়ে ফেনী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিজাম উদ্দীন কাছ থেকে জানতে চাইলে তিনি জানান, এ সমস্ত অনৈতিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সব সময় তৎপর রয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি ডিবির অভিযানও পরিচালিত হয়। স্থানীয় লোকজন ও সুশীল সমাজ আভিযোগ করে বলেন, এই যৌন ব্যাবসার কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে আগামীতে ফেনীতে অবৈধ জুয়া ও যৌন প্রবণতা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়বে তখন কন্ট্রোল করা সম্ভব হবে না। জুয়া ও যৌন ব্যবসা বন্ধের জোর দাবি জানান পুলিশ প্রশাসনের প্রতি।