হজ করতে গিয়ে ৫০ বছর পর স্মৃতিশক্তি ফিরে পেল শফিকুল

মোঃ শফিকুল ইসলাম বয়স যখন ১২ বছর, সংগ্রামের আগে বাকশীমূল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় তখন তিনি পরিবারের অভাব অনটন দেখে বাড়ি থেকে অভিমান করে পালিয়ে যায়। বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর কাজের সন্ধানে ঘুরেছেন দেশের বিভিন্ন জেলায়। কর্মের প্রলোভনে প্রতারণা শিকার হতে হয়েছে অনেক বার। বয়স যখন ১৭ বছর হয় তখন তিনি কর্মের প্রলোভন পড়ে খুলনাতে যায়। সেখানেও তিনি একটি বড় ধরণের প্রতারণা শিকার হয়। আর এই প্রতারণা শিকার হয়েই মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে এবং ভুলে যায় তাঁর মা-বাবা ও আত্মীয় স্বজনের নাম ঠিকানা।

অনেক খুঁজাখুঁজি করেও পাওয়া যায়নি আপন মানুষগুলোর ঠিকানা।এপর থেকেই জীবনের সাথে সংগ্রাম করতে শুরু করে শফিকুল রহমান। কখনো তিনি হকার, কখনো করেছেন অন্যের বাড়িতে কাজ। এমন অবস্থায় শুরু হয় ১৯৭১ সালের যুদ্ধ।তিনি এই যুদ্ধেও অশংগ্রহণ করেন। তিনি জানান,তৎকালীন মেজর জলিল এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

এ সংগ্রামের স্মৃতিগুলো আজও তার দু’চোখে ভাসে এবং বলতেও পারেন। কিন্তু সে মুক্তিযোদ্ধার সনদ গ্রহণ করেনি।কারণ একটাই দেশকে ভালোবেসে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে তার বিনিময়ে কোনো প্রতিদান নিতে চান না। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর বিয়ে করেন খুলনায়।স্ত্রীকে নিয়ে নীলফামারী জেলায় সৈয়দপুর পৌর এলাকায় স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন।সেখানে গড়ে তুলেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান’বিলাস এন্টারপ্রাইজ ও মিনি গার্মেন্টস’।

তাদের কোলজুড়ে একে একে তিনটি পুত্র সন্তান জম্ম হয়।তার ছেলে মিল্টন,লিটন ও মহসিন যখন বড় হয়েছে তখন দাদার বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে শফিকুল রহমান গম্ভীর হয়ে থাকতেন। বলতে পারতেন না মা-বাবার পরিচয় এবং নিজ ঠিকানা।সেখান থেকেই তিনি আল্লাহ কাছে ফরিয়াদ করতে থাকেন, ‘হে আল্লাহ’ মৃত্যুর আগে যেনো আমার আপন ঠিকানা ফিরে পাই। এভাবেই চলে যায় দীর্ঘ ৫০টি বছর।তার ৭২ বয়স পদাপর্ণনে এসে এই বছর ১৯ রমজানে সৌদি আরবে পবিত্র মক্কাতে ওমরা হজ্ব করতে যান মোঃ শফিকুল রহমান। সেখানে কাবা শরীফে দু’হাত তুলে আল্লাহ কাছে অনেক কান্নাকাটি করে গুনাহ্ মাপ ও আপন ঠিকানা ফিরে পাওয়ার জন্য। কে জানে আল্লহ তার মনে আশা পূরণ করবেন। হ্যাঁ একমাত্র আল্লাহ মানুষের চাওয়া পাওয়া পূরণ করতে পারেন।

তার একটি জলন্ত প্রমাণ মোঃ শফিকুল রহমান।হজ্ব শেষে পবিত্র মক্কাতে বাড়ির জন্য কিছু মালামল খরিদ করতে যান একটি দোকানে। সেখানে খরিদ করার সময় দোকানের মালিক সোহেলের সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে একে অপরের ঠিকানা জানতে শুরু করে। দোকানদার সোহেলের বাড়ি কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বাকশীমূল গ্রামে। এ গ্রামের কিছুসংখ্যক মানুষের নাম বলার সাথে সাথে শফিকুল রহমানের স্মৃতি শক্তি পুরোপুরি ভাবে ফিরে আসতে শুরু করে। তখন সোহেল তার ছবি তোলে এলাকার আত্মীয় স্বজনের মোবাইলে পাঠিয়ে দেয়।মক্কা থেকেই ইমুতে আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলেন শফিকুল রহমান।

গত কয়েকদিন আগে স্ত্রী ও তিন ছেলেকে নিয়ে নিজ বাড়ি বাকশীমূল গ্রামে আসেন।তিনি প্রতিনিধিকে বলেন, বাড়িতে এসে দেখেন অসংখ্য মানুষের মেলা।দেখতে আসা মানুষেরা অনেকে আবেক আপ্লুত! তখন তিনি জানতে পারেন বাবা আব্দুল বারী মারা গেছে অনেক আগেই এবং মা আফিয়া খাতুন মারা গেছে ৪ বছর আগে। ৪ ভাই,৩ বোনের মধ্যে ভাই খোরশেদ আলম ও বোন একজন মারা গেছে। বেঁচে আছেন ভাই জামাল হোসেন ও কামাল হোসেন আর দুই বোন।ভাই বোনদের মধ্যে শফিকুল রহমান সবার বড়। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কেউ বয়স্ক আবার কেউ মারা গেছে। বাবার বসত বাড়ি এবং ভাই-বোনকে চিনছেন কিন্তু বাল্যকালের চলার সাথী চাচাতো ভাই হাজী মোঃ আব্দুর রশিদকে ছাড়া সবাই অপরিচিত।

শফিকুল রহমান প্রতিনিধিকে আরো বলেন,আল্লাহ আমাকে স্বয়ং স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ দরবারে লাখো কুটি শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। এখন হঠাৎ করে আমার ভাই-বোন ও আত্মীয় স্বজনকে পেয়ে খুব ভালো লাগছে।আমি আমার মা-বাবার কবর জিয়ারত করেছি এবং দোয়া করেছি।আগের মতো আমরা আবার একসঙ্গে থাকতে চাই।

প্রতিবেশী চাচাতো ভাই হাজী মো: আব্দুর রশিদ বলেন,মোঃ শফিকুল রহমান যে বেঁচে আছে এবং সে বাড়িতে ফিরে আসবে, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। বিদেশে থাকলেও তো ফোনে পরিবারের সঙ্গে কথাবার্তা হয়। শফিকুলের সঙ্গে কারও কোনো যোগাযোগই হয়নি এত বছর।তার কাছ থেকে শুনেছি এত বছর তার কোনো কিছু মনে ছিলো না।হয়তো সেই কারণে সে বাড়ির সবার কথা ভুলে গিয়েছিল। এখন সে বাড়িতে ফিরে আসায় আমরা গ্রামবাসীও খুশি।