মঙ্গলে চাষাবাদ!

পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা যেভাবে দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে তাতে সব মানুষকে খাবার ও পানীয় জলের যোগান আর কতদিন এই ধরণী মাতা দিতে পারবে, কতদিন পর্যন্তই বা এই বিশাল মানবগোষ্ঠীর বোঝা বহন করতে পারবে সে- এই ভাবনা অনেকদিন থেকেই তাড়া করে ফিরছে বিশ্ব মোড়লদের। বিকল্প বাসস্থান এবং খাবার ও পানির বিকল্প উেসর জন্য হন্যে হয়ে খুঁজজে পৃথিবী সদৃশ গ্রহ। শত শত আলোকবর্ষ দূরে পছন্দের গ্রহ খুঁজতে যাওয়া বাস্তবে অসম্ভব, তাই সবেধন নীলমণি কাছের গ্রহ মঙ্গল। বহুদিন থেকেই মঙ্গলকে ঘিরে স্বপ্ন দেখে আসছে মানুষ, একদিন সেখানে বসতি গড়বে। সেই লক্ষ্যে লাল গ্রহটিতে মনুষ্যবিহীন মহাকাশযান পাঠানো হয়েছে, মঙ্গলের মাটিতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে অনুসন্ধানী রোবট যান।

আশা করা হচ্ছে আগামী এক দশকের মধ্যেই মঙ্গলে পা ফেলতে পারবে মানুষ। এখন প্রশ্ন হলো, মঙ্গলে না হয় কৃত্রিমভাবে মনুষ্য বসবাসের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে থাকা যাবে, কিন্তু খাবার আসবে কোত্থেকে? পৃথিবী থেকে তো আর খাবার আর পানি বহন করে সেখানে নিয়ে যাওয়া যাবে না। তাহলে মঙ্গলে গিয়ে লাভ কি? সেখানে স্থায়ী আবাস গড়তে হলে খাবার আর পানির ব্যবস্থা করতে হবে এবং তা করতে হবে মঙ্গলের পাথুরে মাটি থেকেই। বেশ কিছুদিন আগে মঙ্গলের মাটির নিচে বরফ জমাট পানির হূদের সন্ধান মিলেছে। অর্থাত্ মঙ্গল থেকে পানি হয়তো পাবে সেখানে বসতি স্থাপন করা মানুষ। কিন্তু খাবার মিলবে কীভাবে? সেজন্য গ্রিন হাউজ পদ্ধতিতে কৃত্রিমভাবে বিশাল একটি ঘরে ফসল ফলানোর উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা যেতে পারে, কিন্তু তাতে কতটুকুই বা খাবার মিলবে। খাবারের বড় যোগান পেতে হলে মঙ্গলের পাথুরে মাটিতেই ফসলের চাষ করতে হবে। এও কি সম্ভব? যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাককুয়েরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ব্রায়ার্ডো লাওরেন্টের দাবি, মঙ্গলে চাষাবাদ সম্ভব। তবে এজন্য মঙ্গলে চাষাবাদের উপযোগী ফসলের জাত তৈরি করতে হবে এবং সেটা করা যাবে সিন্থেটিক বায়োলজি বা কৃত্রিম জীববিদ্যা প্রয়োগের মাধ্যমে।

এই সিন্থেটিক বায়োলজিটা কি জিনিস? সিন্থেটিক বায়োলজি হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিএনএ সাইন্স এবং কম্পিউটার সাইন্সের সংমিশ্রণে এমন এক বিদ্যা যার মাধ্যমে জীবিত কোনো জীবকোষে সম্পূর্ণ নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্ত করা সম্ভব। যার ফলে জীবকোষটি অন্য ধরনের ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে।

আপাতদৃষ্টিতে মঙ্গলের আবহাওয়া ও ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ ফসল ফলানোর উপযোগী নয় বলে মনে হতেই পারে। কারণ সেখানে তাপমাত্রা অধিকাংশ সময় মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেডের আশ-পাশে ঘোরাফেরা করে। তাপমাত্রা কম হলেও সেখানে কসমিক রে ও আলট্রা ভায়োলেট রে’র মতো সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মিগুলো প্রায় সরাসরি এসে পড়ে। অন্যদিকে মঙ্গলের মাটি এক ধরনের বিষাক্ত কেমিক্যালে পরিপূর্ণ যেটি স্বাভাবিকভাবে কোনো গাছ জন্মাবার জন্য মোটেই সহায়ক নয়।

বিজ্ঞানী লাওয়ারেন্টের মতে, এ সমস্ত সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব। সিন্থেটিক বায়োলজির মাধ্যমে উদ্ভিদের সালোক সংশ্লেষণ (ফটোসিন্থেসিস) এবং সালোক সংরক্ষণ (ফটোপ্রোটেকশন) ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যাবে। ফটোপ্রোটেকশন ক্ষমতা বাড়ানো গেলে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে উদ্ভিদ নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে। তবে মঙ্গলের মাটিতে জন্মাবার উপযোগী উদ্ভিদ উদ্ভাবনের পাশাপাশি সেই লাল গ্রহের মাটিকেও ফসল ফলানোর উপযোগী করে তুলতে হবে। এজন্য এমন অনুজীব তৈরি করতে হবে যেটি মঙ্গলের মাটির বিষক্রিয়া দূর করে তার গুণগত মান বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবে। এসবই সম্ভব সিন্থেটিক বায়োলজির সফল প্রয়োগের মাধ্যমে। গবেষক ব্রায়ার্ডো লাওরেন্ট মনে করেন, এসব গবেষণায় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা হলে এবং এক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সম্মিলিতভাবে কাজ করলে সিন্থেটিক বায়োলজির মাধ্যমে মাত্র এক দশকের মধ্যেই মঙ্গলে ফসল ফলানো সম্ভব হবে। বিজ্ঞানী লাওরেন্টের এই গবেষণা রিপোর্টটি সম্প্রতি ‘দ্য কনভার্সেশন’ নামক বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়।