রাজশাহীতে নতুন নাটক

রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আর মাত্র ৩ দিন বাকি। প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচার চলবে আগামী শনিবার মধ্যরাত পর্যন্ত। কিন্তু শেষ সময়ে বিএনপির চার শতাধিক নেতাকর্মীর আওয়ামী লীগে যোগদান এবং বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের অনেকের কার্যালয় খুলে নৌকার প্রচার চালানোয় নির্বাচনী আবহে যোগ হয়েছে নাটকীয়তা। এটি দল দুটির নতুন কোনো কৌশল কিনা তা নিয়েও চিন্তিত ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। এদিকে বিএনপির নেতারা অভিযোগ করেছেন, আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর পর থেকে রাজশাহীর বাইরের অনেক মামলায় মহানগরীর অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

দলের নেতাকর্মীদের গণগ্রেপ্তার বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে বেশ কয়েকটি লিখিত অভিযোগ করেছেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের মেয়র পদপ্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। তার দাবি, রাজশাহী নগরের বাইরের থানাগুলোর এমনকি নাটোর ও পাবনায় দায়ের করা মামলায়ও মহানগরীর অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এভাবে গ্রেপ্তারে দলটির নেতাকর্র্র্মীরা রয়েছেন আতঙ্কে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মহানগর বিএনপির সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিম আক্তার বুলবুল গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের ডা. কায়সার রহমান মিলনায়তনে আওয়ামী লীগের একটি মতবিনিময়সভায় চার শতাধিক কর্মী-সমর্থককে নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহানগর নেতাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে সেলিম আক্তার বলেন, ‘মহানগরীতে কয়েকজন নেতা আছেন যারা ত্যাগীদের মূল্যায়ন করেন না। নিজেরা যেটা ভালো মনে করেন তা-ই করেন। তাদের কারণে আমার মতো শত শত নেতাকর্মী পদবঞ্চিত। তা ছাড়া রাজশাহীর উন্নয়নের স্বার্থে লিটনের সঙ্গে থাকা একেবারে জরুরি হয়ে পড়েছিল। তাই সব কিছু বিবেচনা করে চার শতাধিক নেতাকর্মী নিয়ে আমি আওয়ামী লীগে যোগদান করেছি।’

নির্বাচনের মাত্র ৪ দিন আগে কেন আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি একা আওয়ামী গিয়ে কী করব। তাই লিটন ছাড়া রাজশাহীর উন্নয়ন যে সম্ভব নয়এই বিষয়টি আমার কর্মী-সমর্থকদের বুঝিয়ে নিয়ে আসতেই দেরি হয়ে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার নেতৃত্বে ১০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আবিদ আবজা রবিনসহ ৪, ৫, ৬, ১০ ও ১১ নম্বর ওয়ার্ডের ৪ শতাধিক নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করেছি। সবাই লিটনের নৌকা প্রতীকের পক্ষে গণসংযোগ করছি।’

মহানগর বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, গত ১১ জুলাই থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত ধানের শীষের অন্তত ১০ পোলিং এজেন্টসহ অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে মহানগরীর বাইরের বিভিন্ন থানার পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এমনকি ২০১৭ সালের ২২ আগস্টের একটি মামলায় গত ২৩ জুলাই মহানগরীর ষষ্ঠীতলা এলাকার বিএনপি কর্মী মো. ডোমেনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে নাটোর জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পাবনার একটি মামলায় মহানগর বিএনপির একজনকে গ্রেপ্তার করে সংশ্লিষ্ট জেলা কারাগারে পাঠানো হয় বলে দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। এ ছাড়া গত ৩০ জুন রাজশাহীর পুঠিয়া থানার একটি মামলায় আসাদুল হক, দেলোয়ার হোসেন, আবিদ হাসান আসকানকে; ১২ জুলাই বোয়ালিয়া থানার মামলায় বোরহানউদ্দিন, আবু, ফাহিম ও মোবারককে; গত ১৯ জুন পুঠিয়া থানার মামলায় গত কয়েক দিনে অন্তত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে রাজশাহী কারাগারে রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে মহানগর বিএনপির দপ্তর সম্পাদক নাজমুল হক ডিকেন বলেন, ‘বিভিন্ন পুরনো মামলা, যেগুলোতে আমাদের নেতাকর্মীরা জামিনে রয়েছেন সেসব মামলায় অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমনকি মহানগরীর বাইরের বিভিন্ন থানার পুরনো মামলায় আসামি করে আমাদের অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সুপরিকল্পিতভাবে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে পুলিশ প্রশাসন এমন ন্যক্কারজনক গণগ্রেপ্তারে মেতে উঠেছে।’

এদিকে গতকাল দুপুরে নগরীর তিন-চারটি ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, বিএনপি-জামায়াতের অনেক কর্মী-সমর্থক নৌকার পক্ষে গণসংযোগ করছেন। এমনকি বিএনপি-ছাত্রদলের ওয়ার্ড পর্যায়ের অনেক কর্মী যারা বিগত সিটি ও জাতীয় নির্বাচনে ধানের শীষ কিংবা বুলবুলের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন এবার তারা ঘোষণা দিয়ে নৌকার পক্ষে ভোট চাইছেন। তারা নিজেরাই নৌকা প্রতীকের নির্বাচনী কার্যালয় বানিয়ে এলাকায় লিটনের পক্ষে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। নগরীর ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম বুধপাড়া ও মোহনপুর মহল্লার বুলবুল, নজরুল ইসলাম, আবু জাফর ও রেজাউল করিম নামের বিএনপি-জামায়াতের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা বিগত সিটি নির্বাচনে ওই এলাকায় বুলবুলের পক্ষে কাজ করেছিলেন। এবার তারা কাজ করছেন লিটনের জন্য।

৩০ নম্বর ওয়ার্ডের মোহনপুর মহল্লার বাসিন্দা বুলবুল ইসলাম বলেন, ‘বিএনপি করি বলে গত সিটি নির্বাচনে বুলবুলের পক্ষে কাজ করেছি। কিন্তু রাজশাহীর উন্নয়নের স্বার্থে এবার নৌকার পক্ষে কাজ করছি। নিজেই নির্বাচনী অফিস বানিয়ে নৌকার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছি। ’

মতিহার থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. গোলাম কাউসার বলেন, ‘আমি নিজে লিটন ভাই ও রাজশাহীতে তার অবদান সম্পর্কে তাদের (বিএনপি-জামায়াতকর্মী) বুঝিয়েছি। এ কারণে তারা ধানের শীষের পরিবর্তে নৌকার পক্ষে কাজ করছে। মহানগরজুড়ে এমন হাজার হাজার বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মী স্বতঃস্ফূর্তভাবে উন্নয়নের স্বার্থে নৌকার পক্ষে কাজ করছে।’

তবে এভাবে নগরজুড়ে বিএনপি-জামায়াতের কর্মী-সমর্থকরা বাস্তবেই নৌকার পক্ষে ভোট করছেন কিনা তা নিয়ে অনেকের মনে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। তারা বলছেন, হয়তো গ্রেপ্তার বা হুমকি-ধমকি থেকে নিজেদের বাঁচাতে তারা এমন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এভাবে তাদের গণহারে দলে ভেড়ানো উচিত নয়। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ক্ষণিকের জন্য তারা দলে ভিড়েছে।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও সমাজ বিশ্লেষক আহমেদ সফিউদ্দিন বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতকে বিশ্বাস করতে নেই। এভাবে নৌকার পক্ষে তারা কাজ করতে পারে না। এটা তাদের এক ধরনের কৌশল হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে যে, নৌকার পক্ষে যেহেতু একটা গণজোয়ার তৈরি হয়েছে, সেই ভাবনা থেকে তারা আসতেও পারে।’

মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন বলেন, ‘যারা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে দলে ভিড়ে ছিল কিংবা দলের আদর্শ যাদের মধ্যে নেই এমন দুই-একজন নেতাকর্মী নৌকার পক্ষে কাজ করছে বলে শুনেছি। তা ছাড়া ধানের শীষের পক্ষে আমাদের নেতাকর্মীরা যাতে কাজ করতে না পারে সেজন্য অব্যাহতভাবে নৌকার ক্যাডার ও পুলিশ প্রশাসন হুমকি দিয়েই যাচ্ছে। গণগ্রেপ্তারে মেতে উঠেছে।’

মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই অনেক বিএনপি নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার সুযোগ খুঁজছিল। কিন্তু তারা পারছিল না। এই সুযোগে অনেকে আওয়ামী লীগে আসছে। আমরা তাদের সাদরে গ্রহণও করছি। আসলে নৌকার পক্ষে একটা গণজোয়ার তৈরি হয়েছে। দলমত নির্বিশেষে সব নাগরিক নৌকার পক্ষে কাজ করছে।’

নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘ধানের শীষের প্রার্থী গ্রেপ্তারের যে অভিযোগ করেছেন, তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে তারাই ব্যবস্থা নেবে।’

তবে মহানগর পুলিশ কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বা মামলা ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে আমার জানা নেই। এমনটা হলে খতিয়ে দেখা হবে।’