যে কারণে বেপরোয়া- এক পুলিশ কর্মকর্তার শেল্টারে বেপরোয়া হয়ে উঠে ঘাতক পিন্টু দেবনাথ। অভিযোগ উঠেছে, ওই পুলিশ কর্মকর্তা সেদিন ব্যবসায়ী স্বপন কুমার সাহার নিখোঁজ হওয়ার জিডি যথাযথভাবে খতিয়ে দেখলে স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর চন্দ্র ঘোষ খুন হতো না। এর আগেই পিন্টু ধরা পড়ে যেত। শুধু তাই নয়, প্রবীর ঘোষ নিখোঁজ হওয়ার সূত্রধরে পুলিশ পিন্টু দেবনাথকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে থানায় ছুটে যান ওই পুলিশ কর্মকর্তা। পিন্টুর পক্ষে তদবির চালান। বিষয়টি নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা অবগত।
নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় সাব-ইন্সপেক্টর থাকা অবস্থায় পিন্টুর সঙ্গে গভীর সখ্য গড়ে উঠে ওই পুলিশ কর্মকর্তার। বর্তমানে তিনি নেত্রকোনা সদর থানায় ইন্সপেক্টর (তদন্ত) হিসেবে কর্মরত। তবে বাসা এখনো নারায়ণগঞ্জ শহরের শাহপাড়া এলাকায় সূতার ব্যবসায়ী তোতা মিয়ার বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে। যার ভাড়া ২০ হাজার টাকার উপরে। ওই পুলিশ কর্মকর্তার নাম উত্তম কুমার।
এদিকে দুটি হত্যাকাণ্ডই অত্যন্ত নৃশংসভাবে সম্পন্ন করে পিন্টু। অথচ হত্যার শিকার দু’জনই পিন্টুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। নিজের গার্লফ্রেন্ডদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে প্রবীর চন্দ্র ঘোষ ও স্বপন কুমার সাহাকে বশ করে পিন্টু। এবং হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করে। তার এক গার্লফ্রেন্ড রত্না রানী চক্রবর্তী গ্রেপ্তার হলেও লাপাত্তা শীলা রানী। শীলা রানী গ্রেপ্তার হলে পিন্টুর অপকর্মের আরো চিত্র বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন নগরবাসী।
২০১৬ সালের ২৭শে অক্টোবর বিকাল ৪টার দিকে বাসা থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হয় শহরের নিতাইগঞ্জের নতুন ২১, জমিদারী কাচারী গলির মৃত সোনাতন চন্দ্র সাহার ছেলে খুচরা কাপড় ব্যবসায়ী স্বপন কুমার সাহা (৪৭)। পরদিন ২৮শে অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন স্বপনের বড় ভাই অজিত কুমার সাহা। জিডি নং-১৪৮৩। এই জিডির তদন্ত করেন ওই সময়ের সদর থানার এসআই উত্তম কুমার। তার অবহেলার কারণে স্বপনের স্ত্রী ১০ দিনের মাথায় ৬ই নভেম্বর ফতুল্লা মডেল থানায় আরেকটি জিডি করেন। জিডি নং-২৮০। এদিকে পিন্টু দেবনাথের সঙ্গে সখ্য থাকায় পুলিশ কর্মকর্তা উত্তম কুমার যথাযথভাবে স্বপন নিখোঁজের জিডিটি তদন্ত করেননি। এমনকি স্বপনের ব্যবহৃত দুটি মোবাইল উদ্ধারেও কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেননি। ফলে অল্প কিছু দিনের মাথায় স্বপনের নিখোঁজের বিষয়টি চাপা পড়ে যায়।
ওদিকে স্বপন নিখোঁজের ২০ মাস পর চলতি বছরের ১৮ই জুন শহরের কালিরবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর চন্দ্র ঘোষ নিখোঁজ হয়। এ ঘটনায় পুলিশ সন্দেহজনকভাবে পিন্টু দেবনাথকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় ডেকে নেয়। খবর পেয়ে নেত্রকোনা থেকে নারায়ণগঞ্জে ছুটে আসে পুলিশ কর্মকর্তা উত্তম কুমার। এবং পিন্টুর পক্ষে তদবির ও সাফাই গায়। ফলে পুলিশ পিন্টুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিতো। এক পর্যায়ে পিন্টুর কর্মচারী বাপন ভৌমিক ওরফে বাবুকে নিখোঁজ প্রবীর ঘোষের মোবাইলসহ ডিবি আটক করে। এবং বাপনের তথ্যমতে পিন্টু দেবনাথকে আটক করা হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ৯ই জুলাই পিন্টুর তথ্যমতে তার ভাড়া বাড়ির নিচতলার সেপটিক ট্যাংকি থেকে প্রবীর ঘোষের ৫ টুকরো লাশ উদ্ধার করা হয়। পিন্টু স্বীকার করে প্রবীরকে ১৮ই জুন নিজের ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে হত্যার পর লাশ ৭ টুকরা করা হয়। পিন্টু গ্রেপ্তার এবং প্রবীরের লাশ উদ্ধারের খবরে নড়েচড়ে বসে পুলিশ কর্মকর্তা উত্তম কুমার।
নিখোঁজের পর পিন্টুর দেখানো মতে সেপটিক ট্যাংকি থেকে প্রবীর ঘোষের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় নতুন করে ডিবির দ্বারস্থ হয় নিখোঁজ স্বপন কুমারের বড় ভাই অজিত কুমার। পরে স্বপনের বিষয়ে তৎপর হয় ডিবি। পিন্টুর সহযোগী বাপনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে পিন্টুর বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য এবং পিন্টুর বান্ধবী রত্না রানী চক্রবর্তীর সন্ধান ও তার মোবাইল নাম্বার দেয়। মোবাইলের কল লিস্ট পর্যালোচনা করে ডিবি জানতে পারে নিখোঁজ স্বপনের মোবাইল ফোন রত্না রানী ব্যবহার করেছে। পরে ডিবি রত্না রানীকে আটক করে এবং তার তথ্যমতে স্বপনের ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করে।
রত্নাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে স্বপন হত্যার ঘটনা আদালতে বর্ণনা করে। এবং পিন্টুর নাম বলে। পরে পিন্টু আদালতে স্বপনকে অপহরণ থেকে শুরু করে হত্যার পর লাশ ৭ টুকরা করে গুম করার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করে। পিন্টুর এমন জবানবন্দির খবরে পুলিশ কর্মকর্তা উত্তম কুমারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কালিরবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী এবং নিহত স্বপনের স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। যেহেতু স্বপনকে হত্যার ২১ মাস পর পিন্টু একই কায়দায় প্রবীরকে হত্যা করেছে সেহেতু স্বপন নিখোঁজের বিষয়টি যথাযথভাবে তদন্ত হলে হয়তো প্রবীর খুন হতো না- এমনটাই এখন বলতে শুরু করেছেন নারায়ণগঞ্জবাসী।
এ বিষয়ে নেত্রকোনা সদর থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) উত্তম কুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মানবজমিনকে জানান, স্বপন নিখোঁজের জিডির তদন্ত তিনিই করেছিলেন। এবং সঠিকভাবেই তা করেছিলেন। এতে কোনো প্রকার গাফিলতি ছিল না। কিন্তু স্বপনের মোবাইল ফোন উদ্ধার হয়নি কেন? উত্তরে তিনি বলেন, ওই সময় মোবাইল বন্ধ থাকায় তা সম্ভব হয়নি। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি তার বিরুদ্ধে ওঠা সকল অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেন। তবে পিন্টুর ব্যবসাস্থল স্বর্ণপট্টিতে যাতায়াতের বিষয়টি অস্বীকার করেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ওই সময়ে স্বপন নিখোঁজের জিডির তদন্তের বিষয়ে হয়তো বাদী না হয় তদন্ত কর্মকর্তার আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল। তাছাড়া যতদূর জানতে পেরেছি ওই সময় সবার মধ্যে একটা কথা আলোচনায় উঠে আসে যে, স্বপন ইন্ডিয়া চলে গেছে। তাই হয়তো তার পরিবারের পক্ষ থেকে তৎপরতা দেখায়নি। তিনি আরো বলেন, প্রবীর ঘোষ নিখোঁজের বিষয়ে ডিবি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেছে বিধায় অল্প সময়ে মামলা ডিটেক্ট করতে পেরেছে। এবং স্বপন নিখোঁজের রহস্যও উন্মোচিত হয়েছে।