সকাল সকাল শিলং শহরে আমাদের অস্থায়ী ডেরা মানে হোটেলে উপস্থিত বাপ্পিদা। স্থানীয় এই গাইডকে নিয়ে আমাদের গন্তব্য চেরাপুঞ্জি। ছোটবেলায় পড়া সেই প্রশ্নের কথা মনে পড়ে গেল—পৃথিবীতে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয় কোথায়? উত্তরে পাওয়া সেই জায়গায়ই চলেছি আজ। শিলং শহর ছেড়ে বেরোতেই চমত্কার সুন্দর রাস্তার সাক্ষাত্ পেলাম। প্রথমেই পথে পড়ল মাওডাক উপত্যকা। মিষ্টি রোদের ঝলক গোটা উপত্যকাকে যেন স্নান করিয়েছে। বর্ষাকালে এমন রোদ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার বলা যায়। একদিকে সারি সারি পাইনগাছ, অন্যদিকে গভীর খাদ। চেরাপুঞ্জি যাওয়ার রাস্তাটিও অসাধারণ। আঁকাবাঁকা। যাত্রাপথে কোথাও কোথাও মেঘের দেখা পেলাম। চেরাপুঞ্জিতে ঢোকার আগে এক সেতুতে দেখা মিলল এক মেঘের ভেলার। সেই ভেলা আমাদের ছুঁয়ে গেল আলতো করে।
উঁচুনিচু পাহাড়গুলো পরস্পরের ঘা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ের উপত্যকায় রঙের বৈচিত্র্য—কোনোটা গাঢ় সবুজ, কোনোটা হালকা সবুজ, কোনোটা আবার হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে।
পথে সকালের নাশতা করে নিলাম অরেঞ্জ রেস্টুরেন্টে। এখানে ১৫০ রুপি দিয়ে ছয় আইটেম তরকারির সঙ্গে পাপড়, রুটি, ভাত যেকোনো কিছু খেতে পারবেন, যত ইচ্ছা তত। সব আইটেমই চেখে দেখলাম। অসাধারণ স্বাদ! আর ওদের পরিবেশন পদ্ধতিও বেশ চমত্কার। চাইলে রেস্তোরাঁর জানালার পাশে বসে মেঘের সঙ্গে সকালের নাশতাটা সেরে নিতে পারবেন।
সব চাখতে গিয়ে বোধহয় একটু দেরিই হয়ে যাচ্ছিল। বাপ্পিদা তাড়া দিলেন। ‘সেভেন সিস্টার্স ফল’ দেখতে হলে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। এটা প্রায় সময়ই মেঘে ঢাকা থাকে। কপাল ভালো হলে দেখা মিলে যেতে পারে সেভেন সিস্টার্স ফলের।
শেষ পর্যন্ত কপাল আমাদের ভালোই ছিল বলা যায়। মেঘ না থাকায় সেভেন সিস্টার্স ফলের অসাধারণ দৃশ্য ভালোভাবেই দেখতে পেলাম। ছবি তুলতে লাগলাম একের পর এক। হঠাত্ বাপ্পিদা বললেন, ‘দেখ নিচে ওই যে তোমাদের সুনামগঞ্জ দেখা যায়।’
এরপর গেলাম চেরাপুঞ্জির ‘মাওসমাই নংগিথিয়াং’ এলাকায়। এখানে মেঘ ছিল, ছিল বৃষ্টিও। চেরাপুঞ্জির প্রকৃত রূপ দেখার জায়গা নাকি এটা। এখানকার ইকোপার্কে বৃষ্টির সৌন্দর্য উপভোগের জন্য রয়েছে নানা ব্যবস্থা। গোলচত্বর থেকে নিচে নেমে গেলাম। ওখানে দুটি দোলনা ঝুলছে। ইকোপার্কের এখান থেকেই সেভেন সিস্টার্স ফলের পানি বেয়ে বেয়ে নামে। এখানে ঢোকার জন্য ১০০ রুপি দিয়ে টিকেট কাটতে হলো। এখানে আছে ‘মাওসমাই’ গুহা। সাইজে ছোট এই গুহার ভিতরে আছে সুড়ঙ্গের মতো রাস্তা। পর্যটকদের চলাচলের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা আছে। ভেজা, কাদা মাখা পথ। সেই পথ কিছু জায়গায় এতটাই সরু যে আমাদের প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে পার হতে হয়েছিল। গুহাটিতে বয়স্ক আর শিশুদের না নিয়ে ঢোকা ভালো। এখানে ২০ রুপি দিয়ে টিকেট নিতে হবে এবং ক্যামেরার জন্য দিতে হবে আরও ২০ রুপি।
গুহা থেকে বের হয়ে গেলাম চেরাপুঞ্জির রামকৃষ্ণ মিশনে। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৩ সালে। এখানে আদিবাসীর হাতে তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি হয়। আছে জাদুঘরও। আদিবাসীদের ঐতিহ্য বেশ কিছু নিদর্শনের দেখা মিলবে এখানে। মিশনের পরিবেশও বেশ নিরিবিলি। এখানে আদিবাসী ও বাঙালি মিলে দুই হাজার ২০০ ছাত্র পড়াশোনা করে।
এর পরের গন্তব্য ‘মাওত্রো ত্রোপ’। এখানে বিশাল দৈত্যাকার একটি পাথরের দেখা মেলে, যা খাসিয়াদের উল্টানো চোঙ্গাকৃতির ঝুড়ির মতো। প্রচলিত লোককাহিনি মতে, পাথরের ঝুড়িটা নাকি আসলে এক অশুভ দৈত্যের। এই দৈত্য মানুষের ক্ষতিসাধন করে বেড়াত। এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ ধারালো লোহা ও পেরেক মেশানো খাবার খেতে দিয়েছিল তাকে। আর এই খাবার খেয়েই নাকি দৈত্যটির মৃত্যু ঘটে। দৈত্যটির সঙ্গে থাকা ঝুড়িটি নাকি একসময় ২০০ ফিট উঁচু পাথরে পরিণত হয়। আমাদের পরের গন্তব্য ‘নোকালিকাই ঝরনা’। ঝরনায় পৌঁছানোর পথে পড়ল বেশ কিছু টিলা। টিলাগুলো কেয়াগাছে ভরা। কেয়া ফুল এই প্রথম দেখলাম। টাইগার লিলির বড় সংস্করণ। চারদিকে চওড়া পাতার মাঝখানে কলার মোচার মতো কাণ্ড থেকে ফুল বেরিয়ে এসেছে। আগ্রহভরে ফুলগুলো দেখলাম। প্রচলিত কাহিনি অনুসারে ‘লিকাই’ নামের এক নারী পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে এখানে আত্মাহুতি দেওয়ায় জলপ্রপাতটির নাম ‘নোকালিকাই’। এটির চারটি ধারা একই সঙ্গে পাহাড় থেকে নিচে নামছিল। এখান থেকেই বাংলাদেশ দেখা যায়। চেরাপুঞ্জিতে ঘুরে বেড়ানোর সুবিধা হলো সব ঝরনা গাড়িতে বসে ঘুরে দেখা যায়। পায়ে হেঁটে পাহাড়ে ওঠার দরকার পড়ে না। চেরাপুঞ্জিকে বিদায় জানিয়ে ফেরার পথে বাপ্পিদাকে জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হলাম, ‘আচ্ছা চেরাপুঞ্জিতে এসে অমন বৃষ্টি তো পেলাম না।’ কথা ফুরোতে না ফুরোতেই মেঘ ঘন হয়ে এলো আর অল্প সময়ের মধ্যে মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বাপ্পিদা বললেন, ‘এই যে শুরু হলো তোর বৃষ্টি। ছবি :লেখক
জে নে রা খা ভা লো
চেরাপুঞ্জি বেড়ানোর সময় মে থেকে নভেম্বর মাস। তবে বৃষ্টির জন্য জুন-জুলাই হলো সবচেয়ে ভালো সময়। চেরাপুঞ্জি মানেই বৃষ্টি। ছাতা, বর্ষাতি ও রাবারের জুতো সঙ্গে নিতে ভুলবেন না। চেরাপুঞ্জিতে ছোট একটি মার্কেট আছে পর্যটকদের জন্য। তবে সবকিছুর দাম একটু বেশি।
মেঘালয়ে সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষা খাসিয়া। পরদেশিদের সঙ্গে অবশ্য হিন্দি-ইংরেজি মেশানো এক মিশ্র ভাষায় কথা বলে স্থানীয়রা। ভাড়া করা ট্যাক্সিই চেরাপুঞ্জিতে বেড়ানোর সবচেয়ে ভালো বাহন। তবে বড় দল হলে শিলং থেকে বাস ভাড়া করেও চেরাপুঞ্জি বেড়িয়ে আসা যায়। শিলং বা চেরাপুঞ্জিতে থাকা, খাওয়া ও গাড়িতে ঘুরে বেড়ানোর খরচটা পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে কিছুটা বেশি। তামাবিল সীমান্তে ভ্রমণ কর দেওয়ার মতো ব্যাংক নেই, এ জন্য বেশ খানিকটা দূরে যেতে হতে পারে। তাই ঢাকা থেকেই ভ্রমণ কর পরিশোধ করে যাওয়া ভালো। এ ছাড়া সীমান্ত পার হওয়ার পর মুদ্রা বিনিময়ের সুযোগও খুব সীমিত। তাই প্রাথমিক ঘোরাফেরার জন্য যত দূর সম্ভব সীমান্ত এলাকায়ই বেশ কিছু ডলার ভাঙিয়ে নিন। তবে শিলং শহরে পুলিশ বাজারে গোল্ডের এরো ট্রাভেলসে ডলার ভাঙাতে পারবেন (ফোন :৯৪৩৬১০০২৪৩)।
ট্যাক্সির জন্য ফোন দিতে পারেন :বাপ্পিদা :+৯১৯৮৬২২০৬৫৫২
আকাশ :+৯১৯৬১৫৯৮৩১৮৭।
কি ভা বে যা বে ন
শ্যামলী বিআরটিসি বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। এটা বৃহস্পতিবার গিয়ে সোমবার ফেরে। অথবা ভেঙে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে সিলেট, এরপর মাইক্রোবাস অথবা সিএনজি করে তামাবিল বর্ডার, সেখান থেকে জিপ অথবা ট্যাক্সি সোজা চেরাপুঞ্জি। ভাড়া দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার রুপি। আবার শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি জিপ বা ট্যাক্সি ভাড়া তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৫০০ রুপি (সাইটসিন ভিজিটসহ)। এছাড়া আছে লোকাল বাসও।