পানিপথের প্রান্তরে

কুয়াশার চাদরে ঢাকা এক শীত সকালে পানিপথের উদ্দেশে রওনা হলাম নয়াদিল্লি রেলস্টেশন থেকে। নির্ধারিত সময়ের ৭ মিনিট আগেই ট্রেন পৌঁছল পানিপথ জংশনে। ঘড়ির কাঁটা তখন ৮টা বেজে ৫০ মিনিট। জায়গাটি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। পুরো জংশনের প্ল্যাটফর্মজুড়ে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর ছোট ছোট খাবারের স্টল। একটি স্টলে এখানকার বিখ্যাত খাবার ‘ছোলে-বাটুরে’ দিয়ে সকালের নাশতা সেরে নিলাম। খেতে খেতেই স্থানীয়দের কাছে জানতে চাইলাম, পানিপথের যুদ্ধগুলো কোথায় হয়েছিল। কেউ কিছু বলতে পারল না। অনুসন্ধানের পর জানতে পারলাম, জায়গাটি পরিচিত ‘কালা-আম্ব’ হিসেবে। জায়গাটির হদিস জেনে একটি অটোরিকশায় চেপে বসলাম।

পানিপথ বর্তমানে হরিয়ানা রাজ্যের একটি জেলা শহর। দিল্লি থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে। আবার শহর থেকে ‘কালা-আম্ব’ পার্কের দূরত্ব আট কিলোমিটার। পানিপথ শহরটি আমাদের মফস্বল শহরের মতোই। শহর ছেড়ে গ্রামের মাঝ দিয়ে পিচঢালা পথে এগোচ্ছি। রাস্তার দুই পাশে সরষে ক্ষেত। বাড়িঘরগুলো বেশ দূরে দূরে। এসব দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম ‘কালা-আম্ব’। সেখানে জানতে পারলাম, আমিই নাকি ওই দিনের প্রথম পর্যটক। বুঝতে পারলাম, ঐতিহাসিকভাবে পানিপথ গুরুত্বপূর্ণ হলেও পর্যটকদের তেমন একটা আনাগোনা নেই। প্রচুর গাছ ও পাখির কলকাকলি যেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির বার্তা দিয়ে যাচ্ছে। পার্কটির ভেতর কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম এবং তাতে যুদ্ধের ম্যুরাল রয়েছে। মধ্যখানে রয়েছে তৃতীয় পানিপথ যুদ্ধের এক স্মারক পিলার। পার্কের একপ্রান্তে ছোট একটি জাদুঘর থাকলেও তাতে পানিপথ যুদ্ধের কোনো স্মারক বা ইতিহাস নেই, আছে হরিয়ানা ও দিল্লির ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থানের ছবি। পার্কটির মূল ফটকে রয়েছে তিনটি যুদ্ধের উল্লেখপূর্বক ইংরেজি ও হিন্দিতে পর্যটন দপ্তর স্থাপিত দুটি শিলালিপি।

এই পানিপথে ভারতবর্ষের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি যুদ্ধ হয়েছিল। এই তিনটি যুদ্ধই ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছিল। প্রথমটি হয় ১৫২৬ সালের ২১ এপ্রিল। সেটি প্রথম মোগল সম্রাট বাবর এবং দিল্লি সালতানাতের শেষ সুলতান ইব্রাহিম লোদির মধ্যে। এই যুদ্ধে জিতে সম্রাট বাবর ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের সূচনা করেন। শুধু তা-ই নয়, এ যুদ্ধেই ভারতবর্ষে বারুদের প্রথম ব্যবহার করেন বাবর। দ্বিতীয় যুদ্ধটি হয় ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর। সুলতান আদিল শাহ্ সুরির সেনাপতি হিমু ও সম্রাট আকবরের অভিভাবক বৈরাম খানের মধ্যে। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মোগল সাম্রাজ্য দৃঢ় ভিত্তি লাভ করে। আর তৃতীয়টি হয়েছিল ১৭৬১ সালের ১৪ জানুয়ারি। মারাঠা ও আফগান শাসক আহমদ শাহ্ আবদালির মধ্যে সংঘটিত হয় এই যুদ্ধ।

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে ৭৫ হাজার সৈন্য নিহত হয়েছিল। যুদ্ধে এত বেশি রক্তপাত হয়েছিল যে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা আমগাছের আম নাকি পরবর্তীকালে কালো হয়ে গিয়েছিল। এ কারণেই নাকি জায়গাটি ‘কালা-আম্ব’ হিসেবে পরিচিতি পায়। বর্তমানে ওই আমগাছটির স্থানেই তৃতীয় যুদ্ধের স্মারকটি রয়েছে।

পার্কটি দেখে যখন বের হচ্ছি, তখন ঘড়িতে সকাল ১১টা। স্থানীয় লোকজন টেম্পোতে করে পার্কে ঢুকছে বনভোজনের উদ্দেশ্যে।

পরবর্তী গন্তব্য সুলতান ইব্রাহিম লোদির সমাধিক্ষেত্র। জায়গাটির হদিস পাচ্ছিলাম না। স্থানীয়রা সমাধিটির সঙ্গে পরিচিতও নয়। যখনই কাউকে জিজ্ঞেস করছি, তখনই তারা হদিস দিচ্ছে বাসস্ট্যান্ডের কাছে অবস্থিত ‘বু আলী শাহ্র’ দরগাহর। পরে জানতে পারলাম, দরগাহর কাছের একটি পার্কে একটি সমাধি রয়েছে। ভাবলাম আগে দরগাহ যাই, সেখানে গিয়ে হয়তো সুলতান ইব্রাহিম লোদির সমাধির হদিস পেলেও পেতে পারি। বুদ্ধিটা আসলেই কাজে লেগেছিল।

কালান্দর তরিকার সুফি বু আলী শাহর (১২০৯-১৩২৪) দরগাহ পানিপথের একটি উল্লেখযোগ্য স্থান। ধর্ম, গোত্র, বর্ণভেদে সব মানুষকে ঐক্যের বাঁধনে বেঁধেছে এই দরগাহ। এটি কালান্দর চকে অবস্থিত বিশাল দরগাহ। পরিচ্ছন্ন ও শ্বেতপাথরের বিশাল চত্বর। দরগায় খাদেমদের কোনো বাড়াবাড়ি নেই। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বাজারের ভেতর দিয়ে সুলতান ইব্রাহিম লোদির সমাধির উদ্দেশে রওনা হলাম।

সমাধিটি তহশিল অফিসের কাছে হরিয়ানা পর্যটনের স্কাই লার্ক ট্যুরিস্ট রিসোর্টের পাশের একটি পার্কে অবস্থিত। যদিও সমাধিটি লোকালয়ের মধ্যখানে অবস্থিত, তবুও পরিচর্যার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। পার্কটিতে কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্থানীয় বাচ্চারা সমাধির ওপর খেলছিল। ছাউনিগুলোয় ভবঘুরেরা ঘুমাচ্ছে। পার্কটির একপ্রান্তে একটি যুদ্ধক্ষেত্রের ধাতব ভাস্কর্য রয়েছে, যাতে সৈন্যদের কারো হাত, কারো পা ভাঙা।

পার্কটির মাঝখানে ইব্রাহিম লোদির সমাধি। ইংরেজরা ১৮৬৬ সালে গ্র্যান্ডট্রাংক রোড পুনর্নির্মাণের সময় সমাধিটি চিহ্নিত করে ‘লাখারি’ ইট দিয়ে সমাধিসৌধটি তৈরি করেন। লখনউতে এই ইটের ব্যাপক ব্যবহার এবং লাখের হিসাবে এটি তৈরি হয়। সমাধিটি ইটের তৈরি একটি উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপর অবস্থিত। পুরো পার্কে একটিমাত্র সমাধিই রয়েছে। সমাধিটির ছবি তুলছি দেখে দুজন তরুণ এগিয়ে এলো এবং জিজ্ঞেস করল—কেন ছবি তুলছি। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে অবাক। তারা বাংলাদেশকে চেনে ক্রিকেটের কল্যাণে। সমাধিক্ষেত্র সম্পর্কে তারা তেমনটা জানে না। ইটের সিঁড়ি অতিক্রম করে সমাধিতে পৌঁছলাম এবং শ্রদ্ধা নিবেদনস্বরূপ ফাতেহা পাঠ করলাম।

এরপর যেতে চেয়েছিলাম সম্রাট বাবরের তৈরি করা ‘কাবুলিবাগ মসজিদে’। কিন্তু সঠিক সন্ধান না জানায় আর যাওয়া হলো না। সেই অতৃপ্তি নিয়ে ফিরলাম দিল্লিতে। ছবি : লেখক

কিভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে দিল্লি অথবা বিমানে সরাসরি দিল্লি। কলকাতা থেকে ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’ বা ‘দুরন্ত এক্সপ্রেস’ মাত্র ১৭ ঘণ্টায় দিল্লি পৌঁছে। পানিপথ জংশন হওয়ায় শিমলা, কালকা, পাঞ্জাবগামী সব ট্রেনই এখানে থামে।