গাজীপুর সিটিতে ভোটের যত হিসাব-নিকাশ

আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরশন গাজীপুরে জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রভাবক রয়েছে। নিজস্ব ভোটব্যাংক ছাড়াও আঞ্চলিকতা, পোশাক শ্রমিকদের সমর্থন, প্রধান দুই প্রার্থীকে বিভিন্ন দল ও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালীদের সমর্থন, দলের ভেতর কোন্দল বা পছন্দ-অপছন্দের নানা সমীকরণ মিলবে মঙ্গলবারের ভোটে।
এমনিতে এলাকাটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শক্তি ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। তবে পাঁচ বছর আগে এখানে নির্বাচনে দল-সমর্থিত প্রার্থীর দেড় লাখ ভোটে পরাজয়ের পর সেই পরিচয় আর গুরুত্ব পাচ্ছে না। আর ২০১৩ সালের ভোটের ফল আত্মবিশ্বাসী করেছে বিএনপিকে।

এবারই প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ভোট হচ্ছে গাজীপুরের সিটি নির্বাচনে। এখানে মোট সাতজন মেয়র প্রার্থী থাকলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর আলম এবং বিএনপির হাসান উদ্দিন সরকার।
অন্য যেকোনো এলাকার চেয়ে গাজীপুরের ভোট নিয়ে আলোচনা আর জনসংযোগ বেশি চলেছে। এখানে ভোট হওয়ার কথা ছিল ১৫ মে। তবে উচ্চ আদালতে রিট আবেদনের কারণে ভোট পিছিয়ে নির্ধারণ হয় ২৬ জুন। আর সময়ের পরিক্রমায় সব দিন শেষ করে এখন রায় দিতে প্রস্তুত গাজীপুরবাসী। রাত পোহালেই সকাল আটটা থেকে শুরু হবে কেন্দ্রে ভোটারদের আনাগোনা। আর এই ভোট নিয়ে দৃষ্টি থাকবে গোটা দেশবাসীর।

বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সব হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে বলছি, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে ভোটাররা ভোট দিতে পারলে প্রত্যেক কেন্দ্রেই ধানের শীষ বিজয়ী হবে। বিশেষ কোনো এলাকার ভোটারদের জন্য নয়, ভোটাররা ভয়হীনভাবে ভোট দিতে পারলে সব সমীকরণ পাল্টে যাবে।’

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের মিডিয়া সেলের প্রধান মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘গাজীপুরে জয়-পরাজয়ে বড় ভূমিকা রাখবে ভাসমান ভোটার এবং শ্রমিকরা। আর এই দুই শ্রেণির ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় জাহাঙ্গীর আলম। তাছাড়া তরুণ ভোটাররাও তাকে ভোট দেবে।’

বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, পত্র-পত্রিকার সার্বিক পরিসংখ্যানেও জাহাঙ্গীর আলম বিএনপির হাসান সরকারের চেয়ে এগিয়ে বলে দাবি করেন মোহাম্মদ আলম।

ভোটব্যাংক

সিটি করপোরেশন এলাকাটি তিনটি সংসদীয় আসনে পড়েছে। এগুলো হলো গাজীপুর-১, ২ ও ৩। বিশাল এই সিটি করপোরেশনের মোট ওয়ার্ড ৫৭টি। এর মধ্যে ৩৫টি পড়েছে গাজীপুর-২ আসনে যার মোট ভোটার সংখ্যা সাত লাখ ৪৩ হাজারের বেশি।

১৮টি ওয়ার্ড আছে গাজীপুর-১ আসনে। এখানে ভোটার সংখ্যা তিন লাখ ২৩ হাজারের বেশি। আর গাজীপুর-৩ আসনের চারটি ওয়ার্ডে মোট ভোটার ৬০ হাজার ৮৮৬ জন।

এই তিন আসনই দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর দখলে। ১৯৯১ সালে গাজীপুর-১ আসন থেকে জেতেন বিএনপির এম এ মান্নান। এরপর সেখানে আর জিততে পারেনি বিএনপির কেউ। আর বাকিগুলোতে সব সময় বড় ব্যবধানে জিতে এসেছে নৌকা মার্কার প্রার্থী।

স্থানীয় অধিবাসীরা বলছেন, অতীতের নির্বাচনী ফলাফল আর ভোটব্যাংকের হিসাবে সুস্পষ্ট ব্যবধানে এগিয়ে আওয়ামী লীগ। তবে যেহেতু এই একটি বিষয়ের ওপরই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে না, তাই আগে থেকে বলা কঠিন আওয়ামী লীগই জিতবে নাকি পাঁচ বছর আগের মতোই বাজিমাত করবে বিএনপি।

কারণ হিসেবে ভোটাররা বলছেন, টানা প্রায় ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে ভোটারদের নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে তেমন কোনো জবাবদিহি করতে হচ্ছে না।

পাঁচ বছরে বিএনপির মেয়রের মূল্যায়ন

২০১৩ সালের নির্বাচনে জয়ী বিএনপি নেতা এম এ মান্নান তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সিংহভাগই পূরণ করতে পারেননি। বিষয়টি স্বীকার করেছেন দলের এবারের প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারও। তবে এজন্য তিনি দায়ী করেছেন সরকারকেই।

নাশকতার একাধিক মামলার আসামি মান্নান দুই বছরেরও বেশি সময় মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। এই সময় তিনি হয় বরখাস্ত ছিলেন, নয় তো ছিলেন কারাগারে।

তবে ভোটাররা এসব কথা কেন মানবে, সেই প্রশ্ন তুলেছে আওয়ামী লীগ। ভোটের প্রচারে তারা তুলে ধরেছে গত পাঁচ বছরের উন্নয়নের বঞ্চনার বিষয়টি। তারা বলছে, ভোটাররা উন্নয়ন চায় আর তা নিশ্চিত করতে পারবেন একমাত্র জাহাঙ্গীর।

পোশাক শ্রমিকদের সমর্থন

পোশাক কারখানা অধ্যুষিত এলাকায় কর্মরত শ্রমিকরা বড় ভোট ব্যাংক। দেশের পোশাক কারখানার বেশির ভাগই গাজীপুরে অবস্থিত। তাই বিপুলসংখ্যক পোশাক শ্রমিকের বসবাস এই সিটিতে। আসন্ন নির্বাচনে ভোটের হিসাব-নিকাশেও গুরুত্ব পাচ্ছেন এই শ্রমিক ভোটাররা।

সাড়ে ১১ লাখ ভোটারের এক-চতুর্থাংশই শ্রমিক। তাই ভোটের ফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবেন তারা। প্রধান দুই দলের প্রার্থীও পোশাক শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে দিয়েছেন নানা প্রতিশ্রুতি।

শ্রমিকরা বলছেন, আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তাসহ জীবনমান উন্নয়নে যিনি পাশে থাকবেন, মেয়র ও কাউন্সিলর হিসেবে তাকেই ভোট দেবেন তারা।

আঞ্চলিকতার টান

দুই প্রধান প্রার্থীর একজন গাজীপুর সদরের, অন্যজন টঙ্গীর। দুই প্রার্থী নিজ নিজ এলাকায় ভালো ভোট টানতে পারবেন বলে আশা করছেন তার সমর্থকরা।

টঙ্গীর ১৫টি ওয়ার্ডে প্রায় সাড়ে তিন লাখ ভোট রয়েছে। এই এলাকায় ভোট পড়ে অন্যান্য এলাকার তুলনায় বেশি। স্থানীয়দের মতে, টঙ্গীর ভোট যে প্রার্থীর পক্ষে বেশি থাকবে, নির্বাচনে সেই প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা বেশি।

১৯৯১ ও ২০১৩ সাল বাদে টঙ্গীতে বরাবরই আওয়ামী লীগের জয় জয়কার। তবে বিএনপির দাবি, তারা এবার এখানে সুবিধাজনক অবস্থানে। কারণ, তাদের প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের বাড়ি এই এলাকায়। কাজেই আঞ্চলিকতার টানে এগিয়ে থাকবেন তিনি।

হাসান সরকার টঙ্গী পৌরসভার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি টঙ্গীর আউচপাড়ার সন্তান।

অন্যদিকে গাজীপুর সদরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম বিএনপির তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন।

জাতীয় পার্টির সমর্থন গুরুত্ববহ হতে পারে

গাজীপুরে বিএনপি সমর্থন পেয়েছে জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর। আর আওয়ামী লীগ সমর্থন পেয়েছে সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির।

গাজীপুরে অতীতের নির্বাচনগুলোতে জামায়াত কখনো ভালো করতে পারেনি। তাই এই দলটির সমর্থন বিএনপিকে কতটা সুবিধা এনে দেবে সেটি নিশ্চিত নয়।

তবে জাতীয় পার্টির সমর্থন আওয়ামী লীগের জন্য সুবিধার কারণ হতে পারে। এই অঞ্চলে জাতীয় পার্টির সে রকম সাংগঠনিক তৎপরতা না থাকলেও উত্তরাঞ্চলে জাতীয় পার্টি অধ্যুষিত এলাকার বিপুল পরিমাণ পোশাক শ্রমিক দলের সিদ্ধান্ত মেনে নৌকায় ভোট দিলে চওড়া হতে পারে জাহাঙ্গীর আলমের হাসি।

আরেক আলোচিত সংগঠন হেফাজতে ইসলামও এই নির্বাচনে একটি প্রভাবক। ২০১৩ সালে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজত কর্মীদের উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে নানা গুজব আর হেফাজত নেতাদের বিকৃত ও আবেগী বক্তব্য আওয়ামী লীগের পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল বলে ধারণা করা হয়।

তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতের গাজীপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান এবার মেয়র পদে নিজেই প্রার্থী। ফলে ভোটে ধর্মীয় আবেগ কাজে লাগিয়ে বিএনপির ফায়দা নেয়ার সুযোগ এবার ছিল না।

ফজলুর রহমান প্রার্থী হয়েছেন মিনার প্রতীক নিয়ে ইসলামী ঐক্যজোটের ব্যানারে। অবশ্য গাজীপুর হেফাজতের যুগ্ম সম্পাদক মুফতি নাসির উদ্দিন সমর্থন জানিয়েছেন হাসান সরকারকে। অন্যদিকে কওমি মাদ্রাসার দাতা হিসেবে পরিচিত জাহাঙ্গীরও সমর্থন পেয়েছেন ছাত্র-শিক্ষকদের একটি বড় অংশের।

প্রচারে হাসান সরকারের শারীরিক অসুস্থতা

ভোটের প্রচারে আওয়ামী লীগ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছে বিএনপির প্রার্থী হাসান সরকারের শারীরিক অবস্থা। হাসান হাঁটাচলা করতে পারেন না স্বাভাবিকভাবে। অন্যের সহযোগিতায় চলাচলের বিষয়টি ভোটাররা দেখেছেন প্রচার চলাকালেই।

আওয়ামী লীগ বলছে, এমন একজনকে মেয়র নির্বাচন করলে গাজীপুরবাসী প্রত্যাশিত সেবা পাবেন না। আর হাসান সরকার পাল্টা জবাব দিয়েছেন, তিনি ‘ঠ্যাং’দিয়ে কাজ করবেন না, কাজ করবেন মাথা দিয়ে। আর তার মাথা কাজ করছে ভালোভাবেই।