নিজ কন্যাকে ১৪ বার রক্ত দিয়েও বাঁচাতে পারলেন না চান মিয়া

কার ভাগ্যে কি আছে তা একমাএ বিধাতাই ভাল জানেন । ভাগ্যের লিখন কেউ খন্ঠাতে পারে না ।আপন মানুষদের মাঝে কেউ পৃথিবী থেকে চলে গেলে সেটা অনেকটা কষ্টের হয়।অকালে চলে যাওয়ায় মুহূর্তেই এলোমেলো করে দেয় সব কিছু । সুখের সংসার পরিনত হয় দু:খের সাগরে। এরকমি একজন দুঃখী মানুষ টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার ব্রাক্ষণবাড়ি গ্রামের চান মিয়া। নিজের প্রাণপ্রিয় মেয়েকে হারিয়ে দুঃখের সাগরে ভাসছেন তিনি।

গরিব ঘরে জন্ম চান মিয়ার। বাবা ভ্যান চালিয়ে কোনো রকমে সংসার চালাতেন। চানমিয়াও বুঝ হওয়ার পর থেকেই কর্মে ঢুকে যান। ২৪ বছর বয়সে বিয়ে করেন তিনি। তবে দীর্ঘদিন সন্তান আসছিল না তার সংসারে। সন্তানের আশায় এদিক-সেদিক অনেক দৌড়াদৌড়ি। বিয়ের পাঁচবছর পরে অবশেষে হাসি ফুটে তার সংসারে। জন্ম নেয় ফুটফুটে কন্যা শিশু।

সন্তানের নাম রাখেন সিনহা। আর্থিকভাবে একটু অসচ্ছল হলেও কন্যাকে নিয়ে সুখেই কেটে যাচ্ছিল চান মিয়ার দিন। একটা সময় চান মিয়া লক্ষ্য করলেন, তার আদরের রাজকন্যা অনেক শুকিয়ে যাচ্ছে, কিছুই খেতে চায় না, হলদে হয়ে যাচ্ছিলো ত্বক। প্রথমে বিষয়টা স্বাভাবিক মনে হলেও সমস্যা বাড়তে থাকায় দেড় মাসের মাথায় কন্যাকে নেয়া হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

ডাক্তাররা যা জানালেন, তা শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল চান মিয়ার। তার রাজকন্যা নাকি থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত! তার সন্তানের আশা ছেড়ে দিতে হবে। কারণ, তার আদরের রাজকন্যার বাঁচার আশা ক্ষীণ! এখন কি করবেন চান মিয়া? ভেবেই কূল পাচ্ছিলেন না তিনি। ১১ দিন হাসপাতালে থাকার পর ফিরে আসেন বাড়িতে।

ডাক্তারের কথায়তো আর বাবার মন মানে না। সেজন্য নিজের সাধ্য অনুযায়ী সব কিছুই করতে রাজি তিনি। প্রতি মাসেই ধর্ণা দিতে হয় হাসপাতালে, কন্যার জন্য লাগে অনেক রক্ত। অবশ্য চান মিয়ার ভাগ্য ভালো, তার নিজের রক্তের গ্রুপের মতই কন্যার রক্তের গ্রুপ এ পজেটিভ।

তিন বছরে কন্যার জন্য নিজের শরীর থেকে মোট ১৪ বার রক্ত দেন চান মিয়া। এতকিছুর পরেও বাঁচাতে পারলেন না তার রাজকন্যাকে। সবাইকে কাঁদিয়ে গত ৮ মাস আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান সিনহা। ছোটো বেলা থেকেই দুঃখ-কষ্টে বড় হওয়া চান মিয়া আরও হতাশ হয়ে পড়লেন।

কন্যার চিকিৎসা করাতে অনেক টাকা ধার-দেনা করেন চান মিয়া। এরমধ্যে দেড় লাখ টাকা তখনও ঋণী ছিলেন তিনি। একদিকে কন্যা হারানোর বেদনা, অন্যদিকে পাওনাধারদের চাপে ঘুম হারাম তার। অবশেষে নিজের দুই সম্বল, ভ্যান আর ঘরটি বিক্রি করে পাওনা টাকার একাংশ মেটান তিনি।

এরপর চলে আসেন রাজধানী ঢাকায়। গত দু’দিন থেকে চালাচ্ছেন রিকশা। কন্যাকে বারবার রক্ত দেয়ায় দুর্বল চান মিয়ার শরীর। এজন্য ঠিকভাবে ঘুরে না তার রিকশার প্যাডেল। তিনি বলেন, রিকশা ঠিকমত চালাতে পারি না, পায়ে অনেক ব্যাথা করে। টাকা পরিশোধ করতে রিকশা চালাচ্ছি। জীবন গেলেও ঋণ পরিশোধ করে দেব।

মেয়ের প্রসঙ্গে জানান, আমাকে বাবা-বাবা বলে ডাকতো। ভাত খাওয়ার সময় প্লেট এগিয়ে দিত। অনেক দুরন্ত ছিল আমার মেয়েটা।

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বাংলামটর মোড়ে চানমিয়ার সাথে মেয়ের কথা বলার এক পর্যায়ে অশ্রুতে চোখ ছলছল করছিল চান মিয়ার। মোবাইলে রাখা মেয়ের ছবি দেখিয়ে চান মিয়া জানান, আগে আরও অনেক ছবি ছিল আমার মোবাইলে, কিন্তু ছবি দেখে কান্নাকাটি করি বলে ডিলিট করে দিয়েছি। এখন মোবাইলে সিনহার মাত্র তিনটা ছবি আছে।

এ সময় চান মিয়া আরও বলেন, আমার স্ত্রীরও থ্যালাসেমিয়া রোগ রয়েছে। এজন্য ডাক্তাররা এখন আর সন্তান নেয়া থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। বিয়ের ৮ বছর পরও স্বামী-স্ত্রীর দিন যাচ্ছে সন্তানহীন। তিনি বলেন, আমার আর এ জীবন ভাল লাগে না। মেয়েটার জন্য অনেক কষ্ট হয়।আমার সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে ।আমার মেয়েকে ঘিরে ছিলো আমার সবসুখ ।