সোমবার (০৪জুন) ইফতার অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বক্তব্য দিয়েছেন তাকে ‘জনগণের সাথে শ্রেষ্ঠ প্রতারণা’ আখ্যায়িত করে করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের কাছে আবারও একতরফা নির্বাচন করার গ্যারান্টি চাচ্ছেন। সম্প্রতি ভারত সফরে তার দেওয়া বক্তব্যে এমনটিই পরিষ্কার হয়েছে।
মঙ্গলবার (০৫জুন) সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে রিজভী বলেন, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত থেকে ফিরে এসে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন,-‘আমরা ভারতকে যা দিয়েছি তা ভারত সারাজীবন মনে রাখবে-আমরা কিন্তু তাদের শান্তি ফিরিয়ে দিয়েছি, আমরা কোনো প্রতিদান চাই না।’ অন্যদিকে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রতিদান চেয়েছেন বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তাই যদি হয়ে থাকে তবে জনগণের জানার অধিকার আছে যে, ভারতের কাছে কী প্রতিদান চাওয়া হয়েছে এব, তাদের কাছ থেকে কী আশ্বাস পাওয়া গেছে?
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ আবারও একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন ও ভোট ডাকাতির নির্বাচনের ষড়যন্ত্র করছে। সেজন্যই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা সাজানো মামলায় আটকে রেখেছে। কিন্তু শেখ হাসিনার সে ইচ্ছা পূরণ হবে না। মানুষ তাদের ভোটের অধিকার ফিরে পেতে বদ্ধপরিকর। কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমেই গণতন্ত্র মুক্তি পাবে, গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে আর তা হবে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই।
রিজভী বলেন, বছর খানেক আগেও প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে গিয়েছিলেন, তখন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতার অনেকগুলো চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির একগুঁয়েমির অজুহাত দেখিয়ে তিস্তার পানির কোন প্রাপ্তিই ঘটেনি। সেসময় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৬২ দফার যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছিল, সেখানে চুক্তি ও সমঝোতার স্মারকের সংখ্যা ছিল ২২টি।
অথচ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে টু শব্দটিও করেনি এবং যৌথ বিবৃতিটিও প্রকাশের কোনো আগ্রহ দেখাননি। কোনোকিছু ঢাকতে গেলে ঢাকনীর ভেতর থেকে কোনো না কোনোভাবে গোপন বিষয়টি বেরিয়ে আসবেই। স্বাধীন দুটি দেশের মধ্যে সহযোগিতায় উভয় পক্ষের প্রত্যাশা থাকে, কিন্তু বাংলাদেশের প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তি মেলাতে গিয়ে দেখা যায় বাংলাদেশের প্রাপ্তি শুভঙ্করের ফাঁকি আর ভারতকে সব দিয়ে দেয়া হয়েছে উজাড় করে।
তিনি বলেন, আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে ‘হাসিনা জানিয়েছেন তার সরকার উত্তর-পূর্ব সীমান্তে জঙ্গীদের দেশছাড়া করেছে, ট্রানজিট দিয়েছে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে বরাবর দিল্লীকে সমর্থন করেছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের বছরে এবার তাই ভারতের সহযোগিতা চাই।’
আসলে প্রধানমন্ত্রীর উল্লিখিত বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে-শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন একতরফা করতে গ্যারান্টি চাচ্ছেন ভারতের কাছ থেকে, এটাই একমাত্র প্রতিদান আশা করেন ভারতের কাছ থেকে, অন্য কিছু নয়। যদিও ওই অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্পষ্ট করে বলেছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে নিজেদের উন্নত দেশে উত্তরণ ঘটাতে শেখ হাসিনার স্বপ্ন বা দৃশ্যকল্প বাস্তবায়নে ভারত তাকে পূর্ণ সমর্থন দেবে। অতএব শেখ হাসিনার শান্তিনিকেতন সফর মহিমামন্ডিত, এক অভূতপূর্ব প্রতিদানের কাব্যিক আলেখ্য, ভোট ছাড়া দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার নিশ্চয়তা পেলেন কী পাশ্ববর্তী দেশ থেকে?
বিএনপির শীর্ষ এই নেতা বলেন, শেখ হাসিনা ভারতের ক্ষমতাসীন মহলকে এরকম বার্তা নাকি দিয়েছেন- ‘মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে সরাতে, বাংলাদেশকে ফের পাকিস্তান বানানোর চক্রান্ত চলছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে পশ্চিমে ও পূবে-দুদিকেই পাকিস্তানকে নিয়ে ঘর করতে হবে ভারতকে।’
রিজভী বলেন, ভারত তাদের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু জনসমর্থনহীন একটি সরকারকে টেকানোর জন্য বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকারকে অবজ্ঞা করছে- যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপের শামিল। ভারতকে উপলব্ধি করতে হবে যে, তারা যদি বাংলাদেশের জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হারানোর সম্ভাবনাকে ঠেকাতে ভ্রান্তনীতি গ্রহণ করে, আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে অনধিকার হস্তক্ষেপ করে তাতে বাংলাদেশের জনগণের মনে ভারতের গণতান্ত্রিক ভাবমর্যাদা ক্ষুন্নই হবে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হিসেবেই জনগণের কাছে বিবেচিত হবে।
রিজভী আরও বলেন, ‘আর বাংলাদেশের প্রতি ভারতের এই নীতি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে শুধু ভারতের পশ্চিমে নয়, পূর্বে স্বাধীন বাংলাদেশেও কাশ্মীরের ন্যায় পরিস্থিতির সম্ভাবনা সৃষ্টি করা ভারতের জন্য কী উচিৎ হবে? মনে রাখা দরকার মানুষের মৌলিক ও মানবিক অধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা কেড়ে নিলে চরমপন্থা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সীমান্ত খোলা থাকবে অথচ ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া উঠবে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাগুলো থেকে বাংলাভাষীদের ঠেলে দেয়ার টালবাহানা, তিস্তার আশ্বাস ঝুলে থাকা, বিপর্যস্তকর রোহিঙ্গা সংকটে ভারতের সহানুভুতি না পাওয়া-এভাবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয় না। ভারতের পত্রিকায় যে প্রতিদানের কথা বলা হয়েছে তা বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর ইঙ্গিত।
রিজভী আরও বলেন, রাজনৈতিক দলের নেতাদের সম্মানে ইফতার মাহফিলে গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের গণতন্ত্র এখন সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, অর্থনীতিও যথেষ্ট শক্তিশালী।’ আসলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে শ্রেষ্ঠ তামাশা। আমি বলব এগিয়ে যাচ্ছে তবে তা পিছনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক এখন ছোট ছোট খালে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সরকারের উন্নয়ন শুধু সাইনবোর্ড আর বিলবোর্ডে শোভা পায়। দেশে সড়ক-মহাসড়ক ও গ্রামীণ সড়ক মিলে ৮৫ হাজার কিলোমিটার সড়কে বেহাল দশা বিরাজ করছে। সড়কের খানাখন্দ আর দুর্ভোগের আশংকায় লাখ লাখ মানুষ ঈদে বাড়ি যেতে পারবে কিনা চিন্তিত। তারা বিকল্পভাবে বাড়ি যেতে ট্রেনের টিকিটের পিছনে ছুটছে, সেখানেও পাচ্ছে না কাঙ্খিত টিকিট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সড়কের বেহাল দশার কারণে প্রতিদিনই বাড়ছে দুর্ঘটনা এবং প্রতিদিন গড়ে ১৬ থেকে ২০জন লোক সড়কে নিহত হচ্ছেন। সরকারের বেপরোয়া লুটপাটের নীতির কারনেই সড়ক-মহাসড়কের দূর্দশা কাটছে না, ঈদের প্রাক্কালে ঘরে ফিরতে চরম দুর্গতির জন্য এই সরকারের প্রতি ধিক্কার জানাই।
তিনি বলেন, গণবিরোধী সরকারের কাছ থেকে জনকল্যাণমুখী বাজেট প্রত্যাশা কেউ করতে পারে না। এরা গণবিরোধী সরকার, জনসম্পৃক্ত ও জনকল্যাণমূলক বাজেট দেবে- এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তারপরেও দেখি আমরা। কালকে বাজেট উপস্থাপন হোক। বাজেটের আদি-অন্ত বিশ্লেষণ করে কী ফুটে উঠে তার ওপর ভিত্তি করে দেখে আমরা প্রতিক্রিয়া জানাবো।
‘গত ১০ বছরে দ্রব্যমূল্য বাড়েনি’- অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে রুহুল কবির রিজভী বলেন, রবি ঠাকুরের ওই গানটা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে- কেউ কখনো খুঁজে কি পায় স্বপ্নলোকের চাবি। এ স্বপ্নলোকের চাবি আছে আপনার অর্থমন্ত্রীর কাছে। তাই এই ধরনের উদ্ভট কথাবার্তা বলেন আর কি।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- দলের ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান, শওকত মাহমুদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আবুল খায়ের ভূঁইয়া, কেন্দ্রীয় নেতা মীর সরাফত আলী সপু, বেলাল আহমেদ, সামসুজ্জামান সুরুজ, আমিনুল ইসলাম, উলামা দলের এম এ মালেক, শাহ নেসারুল হক প্রমুখ।