পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পরিবেশের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। মানুষসহ সব প্রাণের অস্তিত্ব পরিবেশের উপরই নির্ভরশীল। কারণ পরিবেশই প্রাণের ধারক ও বাহক। তাই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ প্রাণের অস্তিত্বের পক্ষে হুমকি। মানুষ যেমন তার প্রয়োজনে পরিবেশকে নিজের উপযোগী করছে; ঠিক তেমনি সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সাথে সাথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতিতে মানুষ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে প্রাণের অস্তিত্ব ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অসচেতনতা এবং অপরিকল্পিত পরিকল্পনা পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিবেশ রক্ষা ও সংরক্ষণ করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ পরিবেশ সংকটের এই দায় সমগ্র মানব জাতির।
পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিবেশের সঠিক ব্যবহার ও সংকটাপন্ন পরিস্থিতির কথা সামনে রেখেই প্রতি বছর ৫ জুনকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। জাতিসংঘ মানব পরিবেশের সুরক্ষা ও উন্নতিকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক কর্মোদ্যোগ আর জনসচেতনতার মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে দিনটি পালিত হয়। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘে পরিবেশবাদের উন্নয়নে সুইডেনের স্টকহোমে ৫-১৬ জুন প্রথম পরিবেশ বান্ধব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ ও বর্ধিতকরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার একটি মৌলিক সাধারণ দৃষ্টিকোণ গঠন করাই ছিল এর লক্ষ। এ সম্মেলনকে স্টকহোম সম্মেলন বলা হয়। একই বছর ১৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৫ জুনকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ঘোষণা করে এবং UNEP (United Nations Environment Programme) নামে পরিবেশবাদী একটি সংস্থা তৈরি করে।
১৯৭৪ সালের ৫ জুন প্রথম বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হওয়ার পর থেকে ১শ’টির বেশি দেশে দিবসটি পালনের মধ্য দিয়ে একটি বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদী প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে। দিবসটি সামুদ্রিক দূষণ, মরুকরণ, ওজোনস্তর, মাটি দূষণ, বশ্বৈকি উষ্ণতা হ্রাস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে গঠিত একটি বৃহৎ পদক্ষেপ। প্রতিবছর একটি বিশেষ প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে দিবসটি পালিত হয়। যা পরিবেশগত সমস্যার প্রতি মানুষের মনোযোগ সৃষ্টি করে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন UNEP (United Nations Environment Programme) ২০১৮ সালের প্রতিপাদ্য হিসেবে ‘প্লাস্টিক দূষণ নিরোধ’- কে নির্ধারণ করেছে। প্রাকৃতিক স্থান, বন্যপ্রাণী এবং নিজেদের স্বাস্থ্যের জন্য প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে দৈনন্দিন জীবনে সচেতনতা সৃষ্টি করাই এ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য।
জাতিসংঘ পরিবেশের প্রতিপাদ্য বিষয়টি পালনের জন্য বিভিন্ন দেশকে আমন্ত্রণ জানায়। যেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসব পালিত হয়। এবার ‘প্লাস্টিক দূষণ নিরোধ’-এর অতিথি দেশ হিসেবে ভারতকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানি এবং সুশীল সমাজ এই প্রতিপাদ্য বিষয়কে পরিবেশ সংরক্ষণের একটি দৃঢ় পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।
প্লাস্টিক সামগ্রীর ওপর অধিক নির্ভরশীলতা কমিয়ে পরিবেশকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। কারণ যত্রতত্র প্লাস্টিকের ব্যবহার পরিবেশকে দূষিত করে প্রাণী জগতের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। মানুষের ব্যবহৃত প্লাস্টিক সামগ্রী পরিবেশকে দূষণ করে জলজ, স্থলজ, বনজ, এমনকি মানবজাতির স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। অতিমাত্রায় প্লাস্টিক ব্যবহার ও এর যত্রতত্র নিক্ষেপ পরিবেশ দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। পলিথিন ব্যাগ, গৃহস্থালির ব্যবহৃত প্লাস্টিক, পণ্যের মোড়ক, কসমেটিকস্ প্লাস্টিক, পানির জন্য ব্যবহৃত প্লাস্টিক বোতল ব্যাপকভাবে ব্যবহারের ফলে প্রকৃতিকে দূষিত করছে। কারণ প্লাস্টিক এমন একটি রাসায়নিক পদার্থ যা সহজে পচে না এবং যার পুনঃপ্রক্রিয়াকরণে প্রচুর সময় লাগে। ফলে পরিবেশের ওপর এটি দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। যেহেতু প্লাস্টিক অপচ্য পদার্থ সেহেতু বন, জল ও স্থলের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে এবং প্রাণীর বাসস্থান ও খাদ্য গ্রহণে ব্যাপক বাধার সৃষ্টি করছে। ফলে সেসব স্থানের প্রাণীর জীবন ধারণ কঠিন হয়ে পড়ছে। এমনকি কোনো কোনো প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। শুধু প্রাণীর ক্ষেত্রেই নয়, প্লাস্টিক মানব দেহে নানা প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে।
উনবিংশ শতাব্দীর আবিষ্কার প্লাস্টিক বর্তমানে সর্ববৃহৎ পণ্য যা বছরে ১ ট্রিলিয়ন হারে উৎপাদিত হয়। কাগজ বা কাপড়ের তুলনায় প্লাস্টিকের স্থায়িত্ব বেশি এবং এর ব্যবহার সহজ হওয়ায় পৃথিবীর সব প্রান্তে প্লাস্টিকের অস্তিত্ব রয়েছে। ১৯৯৭ সালে নাবিক ও গবেষক চালস্ ম্যুর আবিষ্কার করেন- পৃথিবীর বিভিন্ন মহাসাগরে প্রচুর প্লাস্টিক সামগ্রী জমে আছে, যা জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। যেমন- সামুদ্রিক কচ্ছপ ভাসমান প্লাস্টিক ব্যাগকে জেলিফিশ ভেবে ভুল করে খেয়ে ফেলায় মারা যায়। একইভাবে মাছ ও পাখির জন্যও প্লাস্টিক ব্যাগ ক্ষতির কারণ। প্রচুর পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার এবং যত্রতত্র সেগুলো ফেলে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের ড্রেনেজ সিস্টেম ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে সাহায্য করছে। পলিথিনের ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করণে আইন প্রণীত হয়। বাংলাদেশই বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করে ২০০২ সালে। এখন পৃথিবীর অনেক দেশেই প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ আইন চালু আছে।
তবে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ আইন প্রণীত হওয়া সত্তে¡ও প্লাস্টিকের ব্যবহার তেমন কমেনি। দিনটি এক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে এবং পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করবে। শুধু প্লাস্টিক নয়, পরিবেশ দূষিত হচ্ছে নানান কারণে। পরিবেশকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের ফলে পরিবেশ অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। যা ভবিষ্যত প্রজন্মকে অনিরাপদ করে ফেলছে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। ব্যাপক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ, জল, বায়ু ও মাটির উপর প্রচুর চাপ পড়ছে। মানুষের নিজেদের খাদ্য চাহিদা মেটাতে বনের পর বন উজাড় করে আবাদি জমি তৈরি করছে, যার জন্য প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাণী জগৎ। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বনাঞ্চলের নানা ধরনের পশু-পাখি। পরিবেশের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে যে সব প্রয়োজনীয় উপাদান থাকা জরুরি তার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। চাষাবাদ বৃদ্ধি করার জন্য নানা ধরনের রাসায়নিক সারের ব্যবহার মাটির আর্দ্রতা নষ্ট করে মাটিকে দূষিত ও বিষাক্ত করে তুলছে যা গাছপালাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং মানব দেহে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করছে।
সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে মানুষ নিজেদের সুবিধার্থে তৈরি করছে নানারকম প্রযুক্তি, বাড়ছে ক্রমবর্ধমান হারে শক্তি উৎপাদনের চাহিদা যার থেকে নির্গত পদার্থ মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ দূষণে অগ্রণি ভূমিকা পালন করে চলেছে। কলকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়ার কারণে বায়ু দূষণে প্রাণীর বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। অধিক নগরায়ন, যানবাহন বৃদ্ধির প্রভাবে পরিবেশ তার বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। মানুষ শারীরিক অসুস্থতাসহ নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা বর্তমান পৃথিবীর বহুল আলোচিত একটি বিষয়। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পৃথিবীতে সুস্থভাবে প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পরিবেশ সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি। পরিবেশের অংশ হিসেবে মানুষ পরিবেশ থেকে প্রত্যক্ষ সুফল ভোগ করে। তাই পরিবেশ বিপর্যস্ত হলে অন্যান্য প্রাণীর সাথে সাথে মানুষের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হবে। তাই নিজেদের স্বার্থেই মানুষকে পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে ব্যক্তিভিত্তিক সমাধানের সাথে সাথে সমন্বিত মনোভাব একান্ত প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো জনসচেতনতা। যেমন- সামুদ্রিক পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য ওটামুর (Watamu) লোকজন প্রতি শুক্রবার স্থানীয় মহাসাগর থেকে প্লাস্টিক সামগ্রী সংগ্রহ করে।
পরিবেশকে সুস্থ রাখতে গাছ সবচেয়ে বেশি জরুরি। অধিক পরিমাণে বৃক্ষরোপণ ও বনজ সম্পদকে রক্ষা করে বায়ু দূষণের মাত্রাকে কমানো সম্ভব। বাস্তুতন্ত্রের যে সব জীব পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে, তাদের টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যে সব নীতিমালা প্রণীত রয়েছে তার যথাযথ বাস্তবায়ন পরিবেশ দূষণের হাত থেকে পরিবেশকে বাঁচাতে পারে। প্রাণের অস্তিত্বের জন্য পরিবেশের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তাই পরিবেশ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুরক্ষিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।