ক্রিকেটীয় রূপকল্পে পরিবর্তন আনতে হবে

শুরু থেকেই আমরা অত্যন্ত উদাসীন ছিলাম। মূল ক্রিকেটকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে ভেবে টি-টোয়েন্টিকে আমরা অবজ্ঞা-উপেক্ষাও কম করিনি। প্রথম প্রথম আমরা ভাবতাম, এটি থেকে দূরে থাকাই বোধ হয় ভালো। কিন্তু এই সংস্করণটি দেড় দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসে যখন আরো জেঁকে বসছে, তখন আমাদের এর থেকে দূরে থাকার চেষ্টার ক্ষতিকর দিকটিও দৃশ্যমান। কুড়ি-বিশের ক্রিকেটে বাংলাদেশ যখন পায়ের নিচে শক্ত মাটি খুঁজে পেতে লড়ছে, তখন আমাদের নিচের সারির অনেক দলও এই মারকাটারি ক্রিকেট দিয়েই কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের পদধ্বনি শোনাচ্ছে।

নেদারল্যান্ডস ও স্কটল্যান্ডের কথাই বলি। ওরা এখন কত ভালো দল! অস্ট্রেলিয়ায় হওয়া সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওরা আরেকটু হলে আমাদের জন্যও হুমকি হয়ে উঠছিল। আপনি মানুন বা না মানুন, এটি সত্য যে টি-টোয়েন্টিই এখন ক্রিকেটের মূল সংস্করণ হয়ে ওঠার পথে। কারণ এর সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাপারটি এমনভাবে যুক্ত যে আপনি এই সংস্করণ থেকেই সবচেয়ে বেশি টাকা আয় করবেন। তাই নিশ্চিত করেই বলা যায়, নতুন যে দেশগুলো উঠে আসবে, ওরা কিন্তু টেস্ট খেলে উঠে আসবে না। ডাচ-স্কটিশদের কথা বলছিলাম। টি-টোয়েন্টি ধীরে ধীরে ওদের ওয়ানডে ক্রিকেটও সমৃদ্ধ করবে। আর আমরা যে ওয়ানডেতে একটি ভালো জায়গায় আছি, টি-টোয়েন্টিতে ভালো না করলে সেই অবস্থানও ধরে রাখা সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। অর্থের ঝনঝনানিতে ফুলেফেঁপে উঠতে থাকা সংস্করণটি তাই সত্যি আমাদের বিশাল এক চ্যালেঞ্জের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। আমি অবশ্য আশাবাদী মানুষ। বিশ্বাস করি, এই চ্যালেঞ্জও উতরে যাওয়া সম্ভব। শুরু থেকেই না হয় আমরা কিছু শুরু করিনি, কিন্তু এখন তো নতুন করেও শুরু করা সম্ভব। ক্রিকেট প্রশাসকরা যদি তা করেন, তাহলেও বলতে পারি, ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’।

উত্তরণের পথ দেখাতে গিয়ে সাম্প্রতিক একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাও বলতে হয়। বিকেএসপিতে কিছুদিন আগে দ্বিতীয় বিভাগের একটি দল প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে এসেছিল। তো, সেই ম্যাচেই দেখলাম, একজন ব্যাটার বিশাল সব ছক্কায় মাঠের ১০ থেকে ১৫ গজ বাইরে নিয়ে বল ফেলছিল। এ রকম খেলোয়াড় আছে কিন্তু। ওরা হয়তো জানেও না ওদের মেধা কতটুকু। তবে মূল ধারায় আসার সুযোগ পায় না। এদের সবাই যে ভালো খেলোয়াড় হবে, তা নয়। তবে ১০ জনের মধ্যে যে দুজনকে পাওয়া যাবে না, তা কে বলতে পারে। ওই পথটা ওদের জন্য খোলা রাখা দরকার। এই সংস্করণের ভালো দল হতে গেলে অনেক পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথম পদক্ষেপ হলো, সর্বোচ্চ সংস্থাকে এটি মানতে হবে যে সংস্করণটি গুরুত্বপূর্ণ এবং এখানে আমাদের টিকে থাকতে হবে।

টিকে থাকতে গেলে অনেক টুর্নামেন্ট করতে হবে। বিপিএল ‘এলিট’ ক্রিকেটারদের আসর। এর বাইরেও আয়োজন থাকতে হবে। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন পর্যায়ে টি-টোয়েন্টি খেলাটি ছড়িয়ে দিতে হবে। অনেক খেলোয়াড় যেন টি-টোয়েন্টি খেলতে পারে। আমরা হাতে গোনা খেলোয়াড়ের মধ্যেই কিন্তু সব সময় থাকি। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি, এদিকে-ওদিকে এমন অনেক খেলোয়াড় আছে, যারা বিগ হিটার। তাদের মধ্য থেকে বাছাই করা ক্রিকেটারদের যদি মূল খেলার মধ্যে নিয়ে আসতে পারি এবং খেলার সুযোগ তৈরি করে দিই, আমরা হয়তো দেখতে পাব, পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে জাতীয় দলের অর্ধেক খেলোয়াড়ই বদলে যাবে। কারণ টি-টোয়েন্টির মধ্যে একেবারেই ভিন্ন একটি ব্যাপার আছে। এই খেলার জন্য ভিন্ন ধাঁচের খেলোয়াড় দরকার। অনেক খেলার সুযোগ যদি তৈরি করে দিই, আমরা এই মুহূর্তে যাদের নিয়ে ব্যস্ত, তাদের বাইরে যারা, তারা খেলার সুযোগ পাবে। তাহলে ঠিকই খেলোয়াড় বের করে আনা যাবে। আমি নিশ্চিত, তৃণমূল থেকে টি-টোয়েন্টি খেলোয়াড় তুলে আনার এ রকম সংস্কৃতি চালু হলে বিপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিরাও সেখান থেকে কাউকে নেওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহী হবে।

খেলা যখন বেশি হবে, খেলোয়াড়রা খেলার সুযোগ পাবে, ভালো করলে চাহিদা তৈরি হবে, চাহিদা তৈরি হলে কোচরাও ওই ধরনের খেলোয়াড় তৈরির চেষ্টা করবে। বোর্ড থেকেই উদ্যোগটা নিতে হবে। সেই সঙ্গে আরেকটি জিনিসও খুবই জরুরি বলে মনে করি আমি। সেটি ক্রিকেটবোধ। টি-টোয়েন্টি যে ব্যাকরণের বাইরে, তা কিন্তু নয়। এরও একটা ব্যাকরণ আছে। অনেকেরই ধারণা, এটি উল্টাপাল্টা খেলা। বিগ হিট আমরা অনুমোদনই করতে চাই না। একটা ছক্কা মারার পর আরেকটা মারতে গিয়ে বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচ হলে আমরা রাগারাগি শুরু করে দিই। এই মানসিকতা নিয়ে ওই খেলোয়াড় তৈরি হবে না। আরেকটা ছয় মারার কি দরকার…এ রকম বললে ঋষভ পান্ট আর ঋষভ পান্ট হবে না। এটি বোঝা খুব জরুরি। এই সংস্করণেরও যে একটা ডিসিপ্লিন আছে, সেটা অনুধাবন করতে হবে। তাহলে এই মানসিকতায় খেলোয়াড়দের তৈরি হতে দেওয়ার সংস্কৃতিও চালু হবে।

অবশ্যই টি-টোয়েন্টির নেতিবাচক দিকটি আমরা নেব না। সমস্যা হলো, খেলাটির সঙ্গে আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত এবং এটির চর্চা খুব বেশি হলে সবাই সেদিকে যাবে। এই একটি ভয় থাকে। এর ফলে যার এই সংস্করণে খেলার যোগ্যতা নেই এবং অন্য সংস্করণে খেলার যোগ্যতা বেশি, তার খেলাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে যদি সে টি-টোয়েন্টির দিকে যায়। এই ঝুঁকিটা কিন্তু থাকেই। এই জায়গায়টিতে আমরা কিভাবে ভারসাম্য আনব, সে বিষয়ে আমাদের একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এমন হতেই পারে, যার ভালো টেস্ট খেলার সম্ভাবনা আছে, সে টি-টোয়েন্টির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিজের খেলাটিকে নষ্ট করতে পারে। এই জায়গাটিতে নজর রাখতেই হবে।

ওই ছেলের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। যে টি-টোয়েন্টির প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে নিজের খেলা নিয়ে থাকবে, তাকে আমরা কিভাবে পুষিয়ে দেব? সে যেন ওই লোভে না পড়ে। লোভে পড়াই খুব স্বাভাবিক। কারণ টেস্ট খেলে ভবিষ্যতে টি-টোয়েন্টির মতো উপার্জন করা সম্ভব হবে না কিন্তু। যেমন—আমরা মমিনুল হকের কথাই বলতে পারি। বছরে কয়টিই বা টেস্ট খেলে? সে যদি নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং ওই দিকে যায়, ওর ক্যারিয়ারটা নষ্ট হবে। তাতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারি।

মমিনুলের চেয়ে অর্ধেক যোগ্য খেলোয়াড়, সে হয়তো টি-টোয়েন্টি খেলবে এবং বছরে এক কোটি টাকা কামাবে। ওর খেলার ধারাটা ধরে রাখার জন্য আমাদের করণীয় অবশ্যই আছে। ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা যদি না থাকে এবং খেলোয়াড় যদি ওই দিকে যায়, তাহলে খেলোয়াড়কে দোষ দেওয়া যাবে না। কারণ সে তো ধরেই নেবে যে ওটা চেষ্টা করলে আমিও পারব। কিন্তু আমি যদি বলি, ‘না, তুমি ওটা চেষ্টা কোরো না। তোমার জন্য এটিই ঠিক আছে। কিন্তু তোমার যে ক্ষতি হবে, সেটি আমরা পুষিয়ে দেব।’ এই ঘোষণাটি প্রশাসনিকভাবে আসতে পারে। সামাজিকভাবেও মমিনুলকে আমরা সেই সম্মানটি দিতে পারি। চেতেশ্বর পূজারার কথাই ধরুন। অসাধারণ টেস্ট খেলোয়াড়। ভারতে সেই সম্মানটি কিন্তু সে পায়। সামাজিকভাবেও আমরা মমিনুলকে সেই সম্মানের জায়গায় রাখতে পারি।