মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়াচ্ছে অনেকটা বেপরোয়াভাবেই। ফলে এ বছর টানা পাঁচবার সুদহার বৃদ্ধির জেরে ডলারের মূল্য এখন আকাশছোঁয়া। দুই দশকে সর্বোচ্চ দাম এবং আন্তর্জাতিক অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে এ বছর মার্কিন মুদ্রার দাম বেড়েছে ১৮ শতাংশ। ডলারের উচ্চমূল্যে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে মূল্যস্ফীতি
আমদানি পণ্যে অতিরিক্ত ব্যয়ে প্রকৃত আয় কমেছে ভোক্তাদের। এর ফলে বিশ্বজুড়ে মন্দা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার আভাস দিয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কায়রোতে বসবাসের খরচ এতটাই বেড়ে গেছে যে নিরাপত্তারক্ষী মোস্তফা গামাল তাঁর স্ত্রী এবং এক বছর বয়সী মেয়েকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ২৮ বছরের গামাল এখন কায়রোতে একাই থাকেন এবং দুটি চাকরি করেন। তাঁকে অন্যদের সঙ্গে একটি ফ্ল্যাট ভাগাভাগি করে থাকতে হয়। সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁর খাদ্যতালিকা থেকে মাংস বাদ পড়েছে। তিনি জানান, সব কিছুর দাম দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে পরিবারকে দূরে পাঠানো ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের অবস্থা এখন গামালের মতো। কেনিয়ার নাইরোবিতে একজন অটোপার্টস ডিলার এবং তুরস্কের ইস্তাম্বুলে বাচ্চাদের কাপড় বিক্রেতার অভিযোগ একই জায়গায়। মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাঁদের স্থানীয় মুদ্রা দুর্বল হয়ে গেছে। এ কারণে দৈনন্দিন পণ্য এবং পরিষেবার ব্যয় আকাশ ছুঁয়েছে।
এমনিতেই ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের কারণে বিশ্বে খাদ্য ও জ্বালানির দাম বেড়েছে। এর ওপর ডলারের উচ্চমূল্য পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। বিশ্বজুড়েই মন্দার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কর্নেল ইউনিভার্সিটির ট্রেড পলিসির অধ্যাপক এশ্বর প্রসাদ বলেন, ‘শক্তিশালী ডলার বিশ্বের বাকি অংশে একটি খারাপ পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে তোলে। অনেক অর্থনীতিবিদ উদ্বিগ্ন যে ডলারের এই মাত্রাতিরিক্ত উত্থান আগামী বছর বিশ্বব্যাপী মন্দা সৃষ্টি করতে পারে। ’
এ বছর জাপানি মুদ্রা ইয়েনের বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ২২ শতাংশ, ইউরোর বিপরীতে বেড়েছে ১৩ শতাংশ এবং উদীয়মান বাজারের মুদ্রাগুলোর বিপরীতে বেড়েছে ৬ শতাংশ। ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে এশিয়ার মুদ্রাবাজারে যেমন অস্থিরতা চলছে, তেমনি ইউরোপ এগিয়ে যাচ্ছে মন্দার দিকে। গত ২০ বছরে প্রথমবারের মতো এক ইউরোর মূল্য এখন এক ডলারের থেকে কম। ব্রিটিশ পাউন্ডের দামও এক বছর আগের তুলনায় ১৮ শতাংশ কমেছে।
ডলারের বিপরীতে এ বছর বাংলাদেশি টাকার মান পড়েছে ২৫ শতাংশ, শ্রীলঙ্কান রুপির দাম পড়েছে ৭৯ শতাংশ, পাকিস্তানি রুপির দাম পড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ এবং ভারতীয় রুপির দাম পড়েছে ১০ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শক্তিশালী ডলার বিভিন্ন উপায়ে বিশ্বজুড়ে সংকট তৈরি করছে। প্রথমত, ডলারের দাম বাড়লে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, ঋণ পরিশোধে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়। কারণ ঋণ পরিশোধ করার সময় ডলারে রূপান্তর করতে আগের তুলনায় বেশি স্থানীয় মুদ্রার প্রয়োজন হয়। তৃতীয়ত, বিশ্বের দেশগুলো নিজেদের মুদ্রার মান ঠিক রাখতে সুদহার বৃদ্ধি করে। কিন্তু এভাবে উচ্চ সুদহার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে দুর্বল করে এবং বেকারত্ব বাড়ায়।
ক্যাপিটাল ইকোনমিক্সের আরিয়ান কার্টিস বলেন, ‘সহজ করে বললে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য খারাপ খবর। আগামী বছর বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার মধ্যে পড়বে বলে যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এর অন্যতম প্রধান কারণ। ’
আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপিনাথ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার বৃদ্ধিতে শক্তিশালী হচ্ছে ডলার। এতে অন্য দেশগুলোও সুদহার বাড়াচ্ছে। এভাবে বিশ্বজুড়ে সুদহার বৃদ্ধিতে অনেক দেশের আর্থিক অবস্থা আরো কঠিন হচ্ছে। উদীয়মান ও নিম্ন আয়ের অনেক দেশ ঋণের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ডলারের ঊর্ধ্বগতি তাদের সেই ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ অবস্থায় অনেক দেশই মুদ্রাবাজারে হস্তক্ষেপ করছে। এতে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৬ শতাংশের বেশি কমেছে গত সাত মাসে।
আইএমএফের এশিয়া ও প্যাসিফিক ডিপার্টমেন্টের পরিচালক কৃষ্ণ শ্রীনিবাসন বলেন, এশিয়ার বেশ কিছু দেশে মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে ‘খুবই তীব্রভাবে’। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি কঠোর করায় সুদহারে ব্যাপক পার্থক্য তৈরি হয়। ফলে বিভিন্ন দেশ পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বাড়তি খরচের মুখে পড়তে বাধ্য হয়।
বিশ্বজুড়ে মন্দার আশঙ্কা জানিয়ে বিশ্বব্যাংক জানায়, মন্দার কবলে পড়লে বিশ্বের ৩৫ কোটি মানুষ খাদ্যসংকটে পড়বে। এমনকি বিশ্বমন্দার আগেই বর্তমানে বিশ্বে ৪৮টি দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ চরম খাদ্যসংকটে রয়েছে। বিশেষ করে, কোস্টারিকা, বসনিয়া ও রুয়ান্ডার অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ।
জাতিসংঘের আরেক সংস্থা ইউএনডিপির হিসাবে বিশ্বের ৫৪টি দেশে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি দরিদ্র মানুষ বসবাস করে। এ মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে দেশগুলোর ঋণ সহায়তা প্রয়োজন। তা না হলে তারা আরো দরিদ্র হয়ে পড়বে। বলা হয়, মারাত্মক ঋণসংকট উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।