কাতার বিশ্বকাপ: সেরা ফর্মে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা

লাতিন আমেরিকা থেকে বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছে মোট চারটি দল- ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে এবং ইকুয়েডর। কাতার বিশ্বকাপের আগে দুটি করে ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে নিজেদের প্রস্তুতি সেরে নিয়েছে তারা। বিশ্বকাপের পরিষ্কার ফেবারিট আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিল। ফেবারিটের মত জিতেই তারা শেষ করেছে প্রস্তুতি পর্ব। উরুগুয়ে এবং ইকুয়েডর ফেবারিট না হলেও নিজেদের উন্নতির ধারাটা বজায় রেখেছে তারা।

লাতিন আমেরিকার চার ফুটবল পাওয়ার হাউজ নিয়ে এই আয়োজনে থাকছে তাদের দল সম্পর্কে আলোচনা, তাদের শক্তি এবং সামর্থ্যের বিষয়টা। সর্বোপরি বিশ্বকাপে কেমন দল গঠন করতে যাচ্ছে দলগুলো, সে সম্পর্কে আলোকপাত।

ব্রাজিল: সুপার অ্যাটাকিং ব্রাজিলকেই দেখা যাবে এবার?

ব্রাজিল কোচ তিতে এরই মধ্যে প্ল্যান ‘এ’, প্ল্যান ‘বি’ তৈরি করে ফেলেছেন। ঘানা এবং তিউনিসিয়ার বিপক্ষে দুটি ম্যাচেই প্রথমার্ধে যে আকর্ষণীয় এবং আনন্দদায়ক ফুটবল উপহার দিয়েছে তারা, তাতে বোঝাই যাচ্ছে তিতে আল্ট্রা-অ্যাটাকিং প্ল্যান সি’ও তৈরি করে রেখেছেন এবং দেখা যাচ্ছে, তার তিন নম্বর প্ল্যানটাই সবচেয়ে বেশি কার্যকর হচ্ছে।

পুরো বছরজুড়ে কোচ তিতে যে আক্রমণভাগ তৈরি করে খেলতে ব্রাজিলকে অভ্যস্ত করে তুলেছিলেন, ঘানা এবং তিউনিসিয়ার বিপক্ষে সেই অভ্যস্ততা থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেছে তাকে। আগে ছিল দুই উইঙ্গার রাফিনহাকে ডানে এবং ভিনিসিয়ুস জুনিয়রকে বামে রেখে মাঝে ভাসমান ফলস নাইন হিসেবে খেলাতেন নেইমারকে। সঙ্গে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ছিলেন লুকাস পাকুয়েতা। যিনি বলের জোগান দিয়েছেন বেশি।

এই ভ্যারিয়েসনে তিতে যোগ করে দেন রিচার্লিসনকে একজন সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে। একজন উইঙ্গারকে বসিয়ে রেখে লুকাস পাকুয়েতাকে আরেকটু এগিয়ে এনে দায়িত্ব দিয়েছেন উইঙ্গার হিসেবে খেলার জন্য।

কিন্তু এখানে কী হতো, যদি দুই উইঙ্গার এবং একজন সেন্টার ফরোয়ার্ড খেলাতেন তিতে? ঘানার বিপক্ষে দেখা গেছে পাকুয়েতাকে ডান পাশে উইঙ্গার হিসেবে খেলানোর পাশাপাশি ফ্রেডের ভূমিকাতেও নামিয়ে আনা হয়েছিল তাকে। তিউনিসিয়ার বিপক্ষে দেখা গেলো ভিনিসিয়ুসকে বসিয়ে রেখে তার জায়গায় উইঙ্গার হিসেবে খেলানো হলো পাকুয়েতাকে।

নেইমারকে নিয়ে আসা হলো অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে। ফলস নাইন থেকে তাকে তুলে আনা হলো মিডফিল্ডে আক্রমণের উৎস রচনা করার কাজে। ঘানার বিপক্ষে ক্যাসেমিরো এবং নেইমারকে মিডফিল্ডে এমনভাবে সেট করেছিলেন তিতে, যাতে করে উপরে থাকা তিনজন- রাফিনহা, ভিনিসিয়ুস এবং রিচার্লিসন খেলার জন্য যথেষ্ট জায়গা পেয়ে যান এবং প্রতিপক্ষের জন্য আক্রমণের নতুন ধারা তৈরি করতে পারেন।

ঘানার বিপক্ষে পাকুয়েতাকে যে ভূমিকায় খেলানো হলো, তাতে মিডফিল্ড এবং ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডের ভূমিকা একাই পালন করতে পেরেছেন তিনি। যে কারণে দেখা গেলো ঘানা তাদের রিদম ধরে খেলতে ব্যর্থ হয়েছে এবং ব্রাজিলের চাপের মুখে গোল হজম করতে বাধ্য হয়েছে।

ডিফেন্সে মার্কুইনহোসের গতির সঙ্গে কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি প্রতিপক্ষের। ব্রাজিল জয় পেয়েছে ৩-০ গোলে। আরও বেশি গোল দেয়া সম্ভব ছিল তাদের পক্ষে। কিন্তু প্রীতি ম্যাচে প্রতিপক্ষের সম্মানের কথা চিন্তা করেই হয়তো নিজেদের নিভৃত করতে পেরেছিল তারা। যদিও ম্যাচটি ছিল পুরোপুরি এক তরফা।

ব্রাজিলের নতুন এই ফরমেশন হয়তো সব পরিস্থিতিতে সব প্রতিপক্ষের বিপক্ষে সমানভাবে কার্যকর হবে না। কিন্তু এটা তো ঠিক যে, ব্রাজিল কোচ তিতে নতুন নতুন ফরমেশন তৈরির নেশায় মেতে উঠেছেন এবং তিনি দেখতে চাচ্ছেন তার কোন ফরমেশন কোন দলের বিপক্ষে এবং কোন পরিস্থিতিতে কার্যকর হয়ে উঠছে।

আর্জেন্টিনা: মেসির নেতৃত্বে এটাই আর্জেন্টিনার সেরা দল?

বিশ্বকাপের আগে হন্ডুরাস এবং জ্যামাইকার বিপক্ষে দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছে আর্জেন্টিনা। দুটি ম্যাচেই নিজেদের দাপট দেখিয়ে ৩-০ ব্যবধানে জয় তুলে নিয়েছে লিওনেল মেসির দল। সবচেয়ে বড় কথা দুই ম্যাচেই জোড়া গোল করেছেন মেসি।

হন্ডুরাস কিংবা জ্যামাইকার মত দলের বিপক্ষে আর্জেন্টিনা মাঠে নামলে জয় আসবে- এটা চোখ বন্ধ করেই হয়তো বলে দেয়া যায়। কিন্তু টানা ৩৫টি ম্যাচ অপরাজিত থাকা- এটাকে কী বলা যায়? চাট্টিখানি কথা? ৩৫ ম্যাচ অপরাজিত থাকার গল্পটাই ভিন্ন।

মিয়ামি এবং নিউইয়র্কে ম্যাচ দুটি খেলেছে আর্জেন্টাইনরা। মাঠে নামার আগেই ম্যাচ দুটির ভাগ্য কী হতে পারে, তা যেন বলেই দেয়া যাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের শহর দুটিতে মেসিরা দেখিয়েছেন, তাদের আক্রমণভাগ কতটা ধারালো এবং প্রতিপক্ষের জন্য কতটা ভয়ঙ্কর।

হন্ডুরাস জয়ের আশা করতেই পারেনি নয় শুধু, তারা আর্জেন্টিনার সামনে কিছুটা লড়াই করবে সে আশাও করতে পারেনি সম্ভবত। আর্জেন্টাইনদের সামনে স্রেফ উড়ে গেছে হন্ডুরাস।

আর্জেন্টিনার দলটিকে বিশ্লেষণ করার পর বিস্ময় তৈরি হচ্ছে ফুটবলবোদ্ধাদের মধ্যে। মিডফিল্ডের তিন সেনানি রয়েছেন কোচ লিওনেল স্কালোনির হাতে। লিয়ান্দ্রো পেরেদেস খেলছেন দুর্দান্ত গতি নিয়ে, রদ্রিগো ডি পল সেই গতিকে যেন আরও বাড়িয়ে তুলছেন এবং রিদম পরিবর্তন করে প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিচ্ছেন। আর জিওভানি লো সেলসো বলকে নিখুঁত পাসে দিয়ে দিচ্ছে মেসির কাছে।

সেই বলটিকে মেসি নিয়ে যাচ্ছেন প্রতিপক্ষের একেবারে গোলমুখে। মাঠের এমন একটা জোনে তিনি থাকেন, যেখান থেকে তিনি কিছু করে দেখানোর সক্ষমতা রাখেন এবং অধিকাংশ সময়ই প্রতিপক্ষের ডিফেন্স ভেঙেচুরে তছনছ করে দিচ্ছেন।

না হয় একেবারে তার সামনে থাকছেন লওতারো মার্টিনেজ। দুর্দান্ত গতিশীল এবং কুশলি এক সেন্টার ফরোয়ার্ড। মেসির বানিয়ে দেয়া বল কিংবা তার অসমাপ্ত কাজকে দারুণ দক্ষতার সঙ্গে সমাধান করে দিচ্ছেন। যার ফলে গোল শুধু মেসির পা থেকেই নয়, মার্টিনেজের পা থেকেও নিয়মিত পাচ্ছে আর্জেন্টিনা।

মেসি তার ক্যারিয়ারে অধিকাংশ সময়ই দলটাকে এমন পেয়েছেন যে, আর্জেন্টিনা কোচের প্ল্যান ‘এ’তে বলা থাকতো- মেসির কাছে বল দাও এবং আশায় থাকো, প্ল্যান ‘বি’তে বলা থাকতো, মেসির কাছে বল দাও এবং আশায় থাকো এবং তাদের কাছে আর কোনো প্ল্যান ‘সি’ থাকতো না।

কিন্তু সময় বদলে গেছে। এখন দলটি আর পুরোপুরি মেসি নির্ভর নয়। যার ফলে মেসি নির্ভার হয়ে খেলার সুযোগ পাচ্ছেন এবং প্রতিপক্ষের জন্য ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছেন। না হয় তার কাজটি করে দিচ্ছেন লওতারো মার্টিনেজ।

হন্ডুরাসের বিপক্ষে প্রথম ১৫ মিনিটের মধ্যেই গোল। এসেছে মার্টিনেজের পা থেকেই। জ্যামাইকার বিপক্ষে মেসিকে প্রথমার্ধে খেলাননি কোচ। ৫৬ মিনিটে মাঠে নামিয়েছেন মার্টিনেজের পরিবর্তে। তবুও ম্যাচের ১৩ মিনিটের মাথায় গোল আদায় করে নেয় আর্জেন্টিনা। কোচ লিওনেল স্কালোনি দেখার চেষ্টা করেছেন, দলটি মেসিকে ছাড়াও চলতে পারে কি না।

কোচ অনেকটাই সফল। দলটি দাঁড়িয়ে গেছে। প্রতিটি পজিশনে একাদিক যোগ্য অপশন তৈরি হয়ে গেছে তার হাতে। মেসি তো রয়েছেন দুর্দান্ত ফর্মেই। ৫৬ মিনিটে মাঠে নামলেও করেছেন জোড়া গোল। তার পেছনে যে দলটি রয়েছে, তা নিঃসন্দেহে তার ক্যারিয়ারে পাওয়া সেরা আর্জেন্টিনা ফুটবল দল।

উরুগুয়ে এবং ইকুয়েডর: বিশ্বকাপে চমক দেখানোর জন্য প্রস্তুত

দুই প্রস্তুতি ম্যাচের প্রথমটিতে ইরানের কাছে হেরে গিয়েছিল উরুগুয়ে। দ্বিতীয় ম্যাচে কানাডার বিপক্ষে জিতেছে ২-০ গোলে। কোচ দিয়েগো আলোনসোর অনুভূতিটা হলো মিশ্র। বোঝাই যাচ্ছে কাতারে তাদের যাত্রাটা হবে অনেক কঠিন। গত বছর কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর অবশ্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ উরুগুয়ে দল দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন আলোনসো, সেটাতে কতটুকু সক্ষম হলেন তা দেখা যাবে কাতার বিশ্বকাপেই।

ইকুয়েডর বিশ্বকাপের আগে চিলির করা অভিযোগের বিষয়ে একটু বিপাকে ছিল বৈ কি। কিন্তু ইকুয়েডরের ডিফেন্ডার বাইরন ক্যাস্টিলোর ব্যাপারে চিলি যে অভিযোগ করেছিল, তা ধোপে টেকেনি। আপাতত এদিকটাতে স্বস্তি।

তবে, ইকুয়েডরের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, তাদের গোলস্কোরারই নেই। গত চার ম্যাচে কেপভার্দের বিপক্ষে একটিমাত্র গোল করতে সক্ষম হয়েছে লাতিন আমেরিকার এই দেশ। এছাড়া বাকি তিন ম্যাচে কোনো গোল দিতেও পারেনি, হজমও করেনি। মেক্সিকো, সৌদি আরব এবং জাপানের বিপক্ষে কোনো গোল দিতেও পারেনি, হজমও করেনি।

ইকুয়েডরকে নিয়ে বড় প্রশ্ন, কাতার বিশ্বকাপে গোল করতে পারবে তো তারা? কোচ গুস্তাবো আলফারোর সামনে এখন এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।