পার্সি ও লেসি ডানবার মার্কিন দম্পতি। তারা তাদের চার বছর বয়সী একমাত্র ছেলে সন্তান রবার্ট ক্লারেন্স ডানবারকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের লুসিয়ানার ওপোলোসাসের কাছে সোয়েজ লেকে মাছ ধরতে যায়।
কে জানে যে, এই মাছ ধরা ভ্রমণ তাদের বংশের স্থায়ীভাবে ইতি ঘটাবে। তাও আবার নাটকীয়ভাবে! মাছ ধরতে তারা সেই লেকে সকালে গিয়েছিল। তাদের প্ল্যান ছিল পুরো পরিবার সারাদিন মাছ ধরে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরবে। তবে দূর্ভাগ্যজনক ভাবে ববি ডানবার দুপুরের খাবার খাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কোনো প্রকার চিহ্ন না রেখেই উধাও হয়ে যায়।
ববি ডানবার হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার পরিবার পুলিশের দারস্থ হন। পুলিশ প্রথমেই ভেবে নেয় ববি হারিয়ে যায় নি, তাকে কেউ অপহরণ করেছে। তাই পুলিশ পুরো রাজ্য ও দেশব্যাপী অনুসন্ধান চালানো শুরু করে। সেই সঙ্গে কেউ তার সন্ধান দিতে পারলে ছয় হাজার মার্কিন ডলার পুরষ্কার ও ঘোষণা করে। ১৯১২ সালে ছয় হাজার মার্কিন ডলার কি বিশাল পরিমাণ অর্থ অনুমান করতে পারছেন নিশ্চয়ই? যাই হোক ববির পরিবার যেহেতু অনেক ধনী ছিল। তাই তারা অর্থ খরচ করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। আর ববিই তাদের বংশের একমাত্র ছেলে সন্তান। তাই দেশব্যাপী ববির ছবি ছাপিয়ে তার সঙ্গে ববির শারিরীক বিবরণ ছাপিয়ে প্রচার প্রচালনা চালাতে থাকে।
পোস্ট কার্ডে লেখা ছিল- বড় গোল গোল নীল চোখ, চুলের রং কালো তবে বেশি ঘন নয়, গাল গোলাপি ও গায়ের রং অনেক ফর্সা, ছিমছাম স্বাস্থ্য খুব বেশি নয়। বাম পায়ের বুড়ো আঙুলে একটি শিশু যখন পুড়ে যায় তখন খারাপভাবে দাগ পড়ে। পুলিশ ও ববির পরিবারের দীর্ঘ আট মাস ধরে চালানো অভিযানের পর, ববির চেহারা সঙ্গে মিল পাওয়া একটি অল্পবয়স্ক ছেলের কথা পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছায়। ছেলেটিকে মিসিসিপিতে পাওয়া গেছে, সে পুরোপুরি নিরাপদ ও সুস্থ আছে। ববির চেহারা সঙ্গে যে বালকটির মিল পাওয়া যায় সে উইলিয়াম ক্যান্টওয়েল ওয়াল্টার্স নামে এক পিয়ানো মেরামতকারীর সঙ্গে অবস্থান করছিল।
ওয়াল্টার্স দাবি করে, ছেলেটি ববি ডানবার না, বরং তার নাম চার্লস ব্রুস অ্যান্ডারসন, ডাকনাম ব্রুস। তার মায়ের নাম জুলিয়া অ্যান্ডারসন, যে ওয়াল্টার্সদের বাসায় কাজ করত। ওয়াল্টার্সের দাবি অনুযায়ী, জুলিয়ার অনুরোধে সে গত ১৩ মাস ধরে ছেলেটিকে লালন-পালন করে আসছিল। তবে পুলিশ ওয়াল্টার্সের কথা বিশ্বাস না করে তাকে গ্রেফতার করে এবং ডানবার দম্পতিকে সংবাদ দেয় তাদের ছেলেকে শনাক্ত করতে আসার জন্য। সংবাদ পেয়েই ডানবার দম্পতি মিসিসিপিতে ছুটে যান। ববিকে তারা প্রথম দেখাতেই শনাক্ত করতে পেরেছিলেন কিনা, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। কিছু কিছু পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, লেসি ডানবারকে দেখামাত্রই ববি তাকে চিনতে পারে এবং ‘মা’ বলে ডেকে ওঠে। তবে অন্যান্য পত্রিকার বর্ণনা অনুযায়ী, ববি তার মাকে চেনার মতো কোনো লক্ষণ দেখায়নি, বরং সে কেঁদে উঠেছিল। অন্যদিকে লেসি ডানবারও প্রথমে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারেননি যে, ছেলেটি আসলেই ববি কিনা।
একই রকম পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায় ববির ভাই আলঞ্জোর সঙ্গে তার সাক্ষাতের ঘটনা নিয়েও। কিছু পত্রিকার দাবি অনুযায়ী, ববি আলঞ্জোকে চিনতে পারার কোনো লক্ষণ দেখায়নি। তবে অন্য কিছু পত্রিকার বর্ণনা মতে, আলঞ্জোকে দেখে ববি সঙ্গে সঙ্গেই তার নাম ধরে ডেকে ওঠে এবং তাকে চুমু খায়। প্রথম সাক্ষাতের বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও মোটামুটি প্রায় সব পত্রিকা এ বিষয়ে একমত যে, পুলিশ প্রথমে সাময়িকভাবে ববিকে ডানবার দম্পতির সঙ্গে থাকার অনুমতি দেয়। পরদিন সকালে লেসি ডানবার যখন ববিকে গোসল করাতে যান, তখন তিনি ববির শরীরের জন্মদাগ এবং বাম পায়ে একটি পোড়া দাগের চিহ্ন দেখতে পেয়ে তাকে নিজের ছেলে হিসেবে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করেন। ফলে পুলিশ ডানবার দম্পতিকেই ববির পিতা-মাতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং অপহরণের অভিযোগে ওয়াল্টার্সকে আটক রাখে।
ববিকে নিয়ে ডানবার দম্পতি লুইজিয়ানায় ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পরেই সেখানে হাজির হন জুলিয়া অ্যান্ডারসন। ওয়াল্টার্সের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে তিনি ববিকে ব্রুস হিসেবে এবং নিজেকে ব্রুসের মা হিসেবে দাবি করেন। তিনি বলেন, ববি/ব্রুস তার সন্তান, কিন্তু তিনি তাকে মাত্র দুই দিনের জন্য ওয়াল্টার্সের কাছে রেখে অন্য জায়গায় গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য জানা যায়, ববি/ব্রুস আসলে ১৩ মাস ধরে ওয়াল্টার্সের সঙ্গে বসবাস করছিল। পুলিশ জুলিয়ার বক্তব্য যাচাই করার জন্য তার সামনে ববি সহ একই বয়েসের এবং একই দৈহিক গড়নের পাঁচটি বালককে উপস্থিত করে এবং তাদের মধ্য থেকে ববিকে খুঁজে বের করতে বলে। ১৩ মাস ধরে ছেলেকে না দেখায় জুলিয়া তাকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হন। ফলে পুলিশের মনে বদ্ধ ধারণা হয় যে, জুলিয়ার দাবি আসলে মিথ্যা।
পরের দিন সকালে জুলিয়া পুনরায় থানায় যান এবং ববির জামা খুলে তার জন্মদাগ দেখে তাকে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করেন। তবে ততক্ষণে তার আগের দিনের ব্যর্থতা পুলিশের মনে স্থায়ী প্রভাব ফেলে দিয়েছিল। তাছাড়া স্থানীয় পত্রিকাগুলো জুলিয়ার বিবাহ বহির্ভূত অবস্থাতেই তিন সন্তানের জননী হওয়ার ঘটনার উপর আলোকপাত করে তার চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। ফলে আদালতের রায়ও স্বাভাবিকভাবেই জুলিয়ার বিরুদ্ধে যায়। আদালত ববিকে ডানবার দম্পতির সন্তান হিসেবে রায় দেয়, জুলিয়াকে মিথ্যাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে এবং অপহরণের অভিযোগে ওয়াল্টার্সকে কারাদণ্ড দেয়। ববি আদালতের রায় পেয়ে ডানবার দম্পতির সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুখী ও পরিপূর্ণ জীবনযাপন শেষে ৫৮ বছর বয়সে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও চার সন্তান রেখে গিয়েছিলেন।
ব্যাপকভাবে সংবাদপত্রে প্রচারের ফলে, দুই সপ্তাহের বিচারের পর, ওয়াল্টার্সকে ববি ডানবার অপহরণের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। অপরাধের জন্য তাকে শাস্তি হিসেবে ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদন্ড দেয় তবে তা কার্যকর হয়নি। পরে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, তবে মাত্র দুই বছর জেল খেটে তিনি ১৯১৫ সালে জামিন পান। উইলিয়াম ওয়াল্টাসকে বাকি জীবটা অসম্মানের সঙ্গে কাটাতে হয়েছিল। সেই অসম্মান ও হিনম্মতা সহ্য করতে না পেরে মুক্তির ৩০ বছর পর ১৯৪৫ সালের ৭ এপ্রিল বিষ পান করে আত্মহত্যা করেন।
জুলিয়া উত্তর ক্যারোলিনায় ফিরে আসেন, যেখানে তিনি স্থায়ী হন, বিয়ে করেন, সাত সন্তানের মা হন। তাদের মধ্যে একজন খ্রিস্টান হন। তার বংশধরদের মতে, তিনি প্রায়শই ব্রুস সম্পর্কে কথা বলতেন এবং ডানবার পরিবারকে তার ছেলের নির্লজ্জ অপহরণকারী হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন। তবে তার একমাত্র সান্ত্বনা ছিল তার ছেলে একটি ধনী পরিবারে মানুষ হয়ে ভদ্র শিক্ষিত হচ্ছে। ছেলে তার কাছে থাকলে হয় তো তার কিছুই পেতো না। বেঁচে থাকতে জুলিয়া তার ছেলেকে আর কখনোই দেখতে পান নি।
২০০৪ সালে, ববির মৃত্যুর ৩৮ বছর পরে, তার দৌহিত্রী মার্গারেট ডানবার কাটরাইট ব্যক্তিগত কৌতূহল থেকে নতুন করে তার দাদার নিখোঁজ রহস্যের ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করেন। তিনি পুরানো পত্রিকা সংগ্রহ করেন, জুলিয়া অ্যান্ডারসনের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন, এমনকি আদালতে উপস্থাপন করা তথ্য-প্রমাণগুলোও যাচাই করে দেখেন। এক পর্যায়ে তার সন্দেহ থাকে, তার দাদা হয়তো আসলে ববি ডানবার না-ও হতে পারেন। মার্গারেট বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য পরিবারের সদস্যদেরকে ডিএনএ টেস্টের ব্যাপারে রাজি করান। ববি ডানবারের ছেলে, রবার্ট ডানবার জুনিয়র এবং ববির ছোট ভাই আলঞ্জোর ছেলে ডিএনএ টেস্টে অংশগ্রহণ করেন।
ববি যদি সত্যি সত্যিই ডানবারদের সন্তান হতেন, তাহলে টেস্টে অংশগ্রহণকারী দুই চাচাতো ভাইয়ের ডিএনএতে প্রচুর মিল দেখা যেত। তবে টেস্টের ফলাফল থেকে দেখা যায়, তাদের মধ্যে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই! অর্থাৎ ববি আসলে ডানবার পরিবারের সন্তান না, তিনি আসলেই জুলিয়া অ্যান্ডার্সনের ছেলে চার্লস ব্রুস অ্যান্ডারসন তথা ব্রুস! মার্গারেট পরবর্তীতে ২০০৮ সালে এক রেডিও ডকুমেন্টারিতে তার তদন্ত সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন। অ্যান্ডারসন পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন, মামলায় হেরে গেলেও জুলিয়া অ্যান্ডারসন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রায়ই ববির/ব্রুসের কথা উল্লেখ করতেন। অ্যান্ডারসন পরিবারের সদস্যরা সব সময়ই ব্রুসকে ডানবার পরিবার দ্বারা অপহৃত হিসেবে বিবেচনা করত।
উভয় পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জানা যায়, ব্রুস যদিও ববি ডানবার হিসেবেই বেড়ে উঠেছিলেন এবং আপাতদৃষ্টিতে সুখী জীবন যাপন করেছিলেন, কিন্তু মনের গহীনে হয় তো তিনি তার সত্যিকার পরিচয় নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। তিনি তার জীবদ্দশায় একাধিকবার অ্যান্ডারসন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালে ব্রুস, জুলিয়া অ্যান্ডারসনের ছেলে, অর্থাৎ তার সৎ ভাই হলিসের সঙ্গে দেখা করেন। তার বোন জুলসও দাবি করেন, কাছাকাছি সময়ে এক ব্যক্তি তার সঙ্গে দেখা করেন এবং দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন। যদিও তিনি তার সত্যিকার পরিচয় দেননি, কিন্তু জুলসের ধারণা, তিনি ছিলেন ব্রুস।
আসল ববি ডানবারের কি হয়েছিল?
বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে দেরিতে হলেও ব্রুসের সত্যিকার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার ববি ডানবারের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, সে রহস্য আজও সমাধান করা সম্ভব হয়নি। সে কি পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল? নাকি কারো দ্বারা অপহৃত হয়েছিল? মার্গারেট কাটরাইট মনে করেন, ববি হয় তো লেকের পানিতে পড়ে গিয়েছিল এবং সেখানের পানিতে থাকা কুমীরগুলো তাকে খেয়ে ফেলেছিল। তবে এতদিন পরে সেটা নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই।