নিঃশব্দ ঘাতক হার্ট অ্যাটাক আমাদের জীবনকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে। হার্ট অ্যাটাকে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় দুই কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। হার্ট বা হৃদয় আমাদের শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তা সত্ত্বেও আমরা হার্টের স্বাস্থ্য নিয়ে উদাসীন। কিছুটা জেনে-বুঝে আবার কখনও অজান্তেই আমরা হৃদয়কে গুরুত্ব দিই না। হার্টের স্বাস্থ্য এড়িয়ে গেলে তা আমাদের ভবিষ্যতে কঠিন পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যায়।
খারাপ জীবনযাত্রা এবং মানসিক চাপ বাড়তে থাকায় হার্ট কমজোর হতে শুরু করে। যখন হৃৎপিণ্ডের কোনো শিরায় রক্ত জমাট বেঁধে হৃৎপিণ্ডে রক্ত প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করে তখনই হার্ট অ্যাটাক হয়। বয়স, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা, উচ্চ কোলেস্টেরলের সমস্যা, অতিরিক্ত মেদ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মদ্যপান, মানসিক চাপ—এগুলো মূলত হার্ট অ্যাটাকের কারণ।
হৃদরোগের প্রাথমিক লক্ষণ হলো এনজাইনা, শ্বাসকষ্ট হওয়া, অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন হওয়া ইত্যাদি। এনজাইনা হচ্ছে রোগীর সাধারণত বুকে ব্যথা, বুকে চাপ অনুভব করা, বুক ভার হওয়া, দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হওয়া ইত্যাদি। কারও করোনারি আর্টারি বা হার্টের রক্তনালির ৭০ শতাংশ ব্লক হয়ে গেলে তখনই এনজাইনা হয়ে থাকে। কখনও কখনও এনজাইনা থেকে হার্ট অ্যাটাক হয়।
আবার করোনারি ধমনি যখন ১০০ শতাংশ ব্লক হয়, তখনই হার্ট অ্যাটাক হয়। অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের ফলেও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। হার্ট অ্যাটাক একটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা, যেখানে জীবন ও মৃত্যু খুব কাছাকাছি চলে আসে।
প্রায়শই হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক উপসর্গগুলো আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। অথচ চিকিৎসকেরা বলছেন, প্রাথমিক উপসর্গগুলো দেখে সাবধানতা অবলম্বন করতে পারলে ঝুঁকি কমানো সম্ভব। ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশনের এক গবেষণা মতে, হৃদরোগের প্রাথমিক উপসর্গ খেয়াল না করলে তার ফলে কেবল মৃত্যু নয়, বেঁচে থাকলেও অনেক জটিলতা নিয়ে বাঁচতে হয়।
অনেক সময় হার্ট অ্যাটাক হলেও সঠিকভাবে বোঝা সম্ভব হয় না। সমস্যা হলো কখনও কখনও বুকে কোনো ধরনের ব্যথা ছাড়াই হার্ট অ্যাটাক হতে পারে, ফলে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কি না তা খুব ভালো করে বোঝা যায় না।
ব্যস্ততার কারণে অনেক সময় সেই লক্ষণগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যার কারণে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকের কারণে প্রাণ যায় অনেকের , অথচ একটু সতর্কতা আর প্রথম থেকেই সঠিক পদক্ষেপ নিলে হার্ট অ্যাটাক থেকে সহজেই বাঁচা যায়।
চিকিৎসকের মতে, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট আর হার্ট অ্যাটাক দুটি বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়। যার কারণে চিকিৎসকরাও রোগীকে দেখার সময় পায় না ।
হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে রোগীর ক্ষেত্রে প্রায় ৪৫ থেকে ১ ঘন্টার মতো সময় থাকে, তার মধ্যে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলে রোগীকে সুস্থ করা যায়। যদি চোখের সামনে দেখেন কারণ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে তাহলে যথাযথ বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে ফলো করতে হবে সিওএলএস (কম্প্রেশন অনলি লাইফ সাপোর্ট)।
সিপিআর-কে আসলে কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন বলা হয়, যাতে অচেতন রোগীর বুকে চাপ দেওয়া হয় এবং কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দেওয়া হয়, যাতে ফুসফুসে অক্সিজেনের ঘাটতি না হয়। এটি হার্ট অ্যাটাক এবং শ্বাসকষ্টের ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির জীবন বাঁচাতে পারে। সিপিআর জরুরি পরিস্থিতিতে দেওয়া একটি মেডিকেল থেরাপি হিসাবে বিবেচিত হয়। এটি একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি যা এমন লোকদের জীবন বাঁচিয়েছে যাদের প্রায়ই শ্বাস নিতে সমস্যা হয়।
প্রথমে দেখে নেবেন যে আপনি নিজে সেখানে নিরাপদ কি না । তারপরে দেখবেন আপনার সামনে অসুস্থ ব্যক্তি নিশ্বাস নিচ্ছেন কি না কিংবা কোনো রেসপন্স করছে কি না । যদি দেখেন কোন কথা বলছে না, নড়াচড়া করছে না, কিংবা অস্বাভাবিক নিশ্বাস নিচ্ছেন যাকে বাংলায় বলা হয় খাবি খাওয়া। তাহলে দ্রুত কাছের অন্য কাউকে ডেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে বলুন। তারপর মুহূর্তের মধ্যে দেরি না করে আপনার দুটো হাতের আঙুল লক করে তালুর হিল দিয়ে অসুস্থ ব্যক্তির বুকে ১ থেকে ৩০ পর্যন্ত গুনে চাপ দিতে থাকুন। দেখবেন যেন আঙুল বুকে স্পর্শ না করে।
এটি মূলত একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে পরপর করা সম্ভব নয় তাই একজন শেষ হলে অপরজনকে একই কাজ করতে বলুন। যতক্ষণ না চিকিৎসকরা সেখানে এসে পৌঁছান কিংবা অ্যাম্বুলেন্স আসে ততক্ষণ পর্যন্ত এই কাজটি করতে হবে। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের ক্ষেত্রে এই কাজটি করলে দ্রুত রোগী সুস্থ হয়ে যাওয়ার অনেকাংশে সম্ভাবনা থাকে। বর্তমান দিনে সিওএলএস ট্রেনিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পর্কে যারা জানেন বা ট্রেনিং নিয়েছেন তাদের এই ধরনের কাজ করা উচিত। না হলে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের এই ধরনের কাজ করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
জীবন বাঁচবে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি বা বাইপাস সার্জারি সাধারণত হার্ট অ্যাটাক রোগীদের জন্য করা হয়। এটি কার্ডিওলজির একটি পদ্ধতি যাতে হৃৎপিণ্ডের পেশিগুলোতে রক্ত সরবরাহকারী ধমনীর ব্লকগুলো ঠিক করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে রোগীদের করোনারি ধমনিতে স্টেন্টও ব্যবহার হয় যাতে রক্ত চলাচলে কোনো সমস্যা না থাকে।
চিকিৎসকের মতে, ওবেসিটি, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস, ধূমপানে আসক্তি, হাই কোলেস্টেরল, হাইপার টেনশন ইত্যাদি হার্টের রোগকে টেনে আনতে ওস্তাদ। এদের মধ্যে বেশির ভাগ লাইফস্টাইল ডিজিজ হলেও একমাত্র ধূমপান পুরোটাই নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাই প্রথমেই ধূমপান বাদ দিতে হবে। তারপর লাইফস্টাইলের কারণে হওয়া অসুখগুলো ঠেকাতেও যত্নশীল হতে হবে। যাদের পরিবারে হার্টের অসুখের ইতিহাস আছে, তাদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
হাঁটাচলার সময় বুকে কোনো রকমের চাপ বা অস্বস্তি হচ্ছে কি না খেয়াল রাখুন। অনেকের ক্ষেত্রে বুকে চিনচিনে ব্যথা থেকে জ্বালাও হয়। তেমনটা হলেও তাই সাবধান হতে হবে।
সার্বিকভাবে হার্ট ভালো রাখতে গেলে কয়েকটা নিয়ম মানতেই হয়। যেমন:
প্রথমেই পাত থেকে বাদ দিন তেল-মশলার খাবার। যখন-তখন তেলেভাজা, ফাস্ট ফুডও বন্ধ করতে হবে। রেড মিট খুব ভালোবাসলে খান, তবে সপ্তাহে দুই পিসের বেশি নয়। কিন্তু হার্টের অসুখ থাকলে বা খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে থাকলে একেবারেই চলবে না।
ফ্যাট জাতীয় খাবার শরীরের প্রয়োজন আছে। কিন্তু অসুখ ও ওজন বুঝে, তাই ঠিক কতটুকু ফ্যাট শরীরে লাগবে তা আগে জেনে নিন ডায়েটেশিয়ান ও চিকিৎসকদের কাছ থেকে। তার চেয়ে বেশি ফ্যাট চলবে না।
রাতের ঘুম আর সবুজ শাকসবজি খাওয়া, এই দুটোর সঙ্গে আপস করবেন না কখনও। রাত জেগে অফিস করতে হলে পেশা বদলান। একান্তই তা সম্ভব না হলে দিনের বেলা পর্যাপ্ত ঘুমান। যদিও দিনের ঘুম কখনোই রাতের ঘুমের বিকল্প হতে পারে না।
প্রতি দিন একটানা হাঁটুন অন্তত ২৫-৩০ মিনিট। যাদের হাঁটার নানা সমস্যা রয়েছে, তারা অন্তত সপ্তাহে ১৫০ মিনিট শরীরচর্চা করুন। হার্ট অ্যাটাক হলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি এবং চিকিৎসকের দেওয়া নিয়ম মেনে চলুন।