‘বিমানটা ওপর-নিচে লাফাচ্ছিল ফুটবলের মতো করে’

ভারতে স্পাইসজেটের একটি বিমান প্রায় ২ শ জন যাত্রী এবং ক্রু নিয়ে মুম্বাই থেকে পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুর যাচ্ছিল। বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজটি আকাশে অস্থিরতার মধ্যে পড়ায় অন্তত ১৭ জন আরোহী আহত হয়েছেন। ওই ফ্লাইটে থাকা অমিত বাউল তার ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। মুম্বাইতে এক উষ্ণ রবিবারের সন্ধ্যায় আমরা বিকেল ৫টা ১৩ মিনিটে পূর্বের শহর দুর্গাপুরের উদ্দেশ্যে দুই ঘণ্টার ফ্লাইটে যাত্রা করি। খবর বিবিসি বাংলার।

ফ্লাইটের সময় অসাধারণ কিছুই ঘটেনি। বিমানটি ছিল ধারণক্ষমতা অনুযায়ী পরিপূর্ণ। সময়মতো খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল। যাত্রীরা হয় ঘুমিয়ে বা মোবাইল ফোনে ব্যস্ত ছিল। আমি গত চার মাসে মুম্বাই এবং দুর্গাপুরের মধ্যে ছয় বার উড়েছি। স্পাইসজেটকে পছন্দ করি, কারণ এটি বিরতিহীন ফ্লাইট চালায়।
নির্ধারিত অবতরণের পঁয়ত্রিশ মিনিট আগে আমি একটা হালকা ঝাঁকুনি অনুভব করলাম। অস্বাভাবিক কিছু ছিল না তা। আমি তখন সিট বেল্টটা বেঁধে নিলাম। কিন্তু বিমানটি নামা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি ব্যাপক খারাপ হয়ে গেল। পরবর্তী ১৫-১৭ মিনিট ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ মুহূর্ত।

জানি না আমরা কোনো ঝড়ের মধ্যে পড়েছিলাম কিনা। তবে প্লেনটি ওপরে ও নিচে এবং পাশের দিকে ব্যাপকভাবে দুলতে শুরু করল। বোয়িং ৭৩৭টি যেন একটা রাবারের বলের মতো ওপরে-নিচে করছিল। মনে হচ্ছিল যেন এক শ তলা ভবন থেকে ধপাস করে পড়ছিলাম। আবার তারপর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই যেন লাথি মেরে সেই উচ্চতায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। আমি শক্ত করে সিটের হাতল ধরে রাখলাম।

যারা সিট বেল্ট বেঁধে রাখতে ভুলে গিয়েছিল তারা সিট থেকে ওপরে-নিচে করছিল। অনেকে ওপরের লাগেজ বিনে আঘাত পায়। আমার সামনে একজন মহিলা তার বছর দশ বয়সী মেয়েকে নিয়ে বসেছিলেন। তাদের মাথা লাগেজের বিনে আঘাত করে কয়েকবার। শেষবার, মহিলাটি নেমে এসে পড়লেন আমার পায়ের ওপর। আমার পা ছিল সিটের সারির মধ্যে ফাঁকা জায়গায় রাখা। ওই নারী এতটাই আঘাত পেয়েছিলেন যে তিনি মেঝেতেই পড়ে রইলেন সিটের হাতল আঁকড়ে ধরে।

যাত্রীরা চিৎকার-চেঁচামেচি করছিল। কেউ কেউ প্রার্থনা করতে লাগলেন। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকানোর চেষ্টা করলাম। লক্ষ্য করলাম অন্ধকার। পাইলট সমানে যাত্রীদের সিট বেল্ট বাঁধার কথা বলে যাচ্ছিলেন। এটা ছিল এক মহাবিপর্যয়। গ্যালি থেকে খাবারের বর্জ্য উড়ে যাচ্ছিল। খাবারের অবশিষ্টাংশ এবং পানীয়ের কাপ এবং ক্যান পড়ে আইলের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। ঝাঁকুনির কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অক্সিজেন প্যানেল খুলে মাস্কগুলো নিচে নেমে এসেছিল। অনেক মানুষ আহত হয়েছিলেন। ছাদে অনেক রক্তের দাগ দেখেছি। যাত্রীরা ব্যথা এবং ফোলাভাব কমাতে সমানে ‌বরফ বরফ’ বলে চিৎকার করছিলেন। একজন যাত্রী বলছিলেন, ‌`শুধু প্রার্থনা করুন, প্রার্থনা করতে থাকুন’।

একটা সময় মনে হয়েছিল আর বেঁচে ফিরব না। অবশেষে যখন বিমানটি সন্ধ্যা ৭.১৫ মিনিটে অবতরণ করল, তখন মনে হলো মৃত্যুর চোয়াল থেকে ফিরে এসেছি। আমরা সবাই পাইলটদের আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। সবচেয়ে খারাপটা তখনো যেন বাকি ছিল। অ্যাম্বুল্যান্স এসে আহত যাত্রীদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে এক ঘণ্টা সময় লেগেছে। সেখানে কোনো ডাক্তার দেখা যায়নি। প্যারামেডিকরা ব্যথানাশক ওষুধ দিচ্ছিলেন এবং ব্যান্ডেজ পরাচ্ছিলেন। পর্যাপ্ত হুইল চেয়ার ছিল না। এটা স্পষ্ট ছিল যে, দুর্গাপুর বিমানবন্দরে যথাযথ প্রাথমিক চিকিৎসা সুবিধা নেই। পরে আরো অনেক আহত যাত্রীকে হাসপাতালে দেখি আমি।

(ভারতের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এই ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। তাদের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিমানটি অবতরণের সময় ‌‌‌গুরুতর দুলুনি অনুভব করেছিল এবং অটো-পাইলট ব্যবস্থা দুই মিনিটের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ক্রুরা ম্যানুয়ালি বিমানটি ওড়াচ্ছিলেন তখন)।