এখন রমযান মাস। এ মাসে মুসলমানরা কমবেশি সবাই মসজিদে নামায পড়ে, তাই বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় এ মাসে টুপি বিক্রি হয় সর্বাধিক। সামনেই আসছে ঈদ, পাঞ্জাবীর পাশাপাশী অবশ্যই টুপি চাই। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিযোগী হাফেজ সালেহ আহমাদ তাকরীম একটি টুপি পড়ে অংশগ্রহণ করে। এবং প্রথম স্থান অর্জন করে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের সুনাম বয়ে এনেছেন। এরপর থেকে “তাহফিজ টুপি” নামে সেই টুপিটি ভাইরাল হয়ে যায় যায়। এবং বাজারে প্রচুর চাহিদা বেড়ে যায়।
যেভাবে তৈরী হয় টুপি -মগ্রামের বধুরা ঘরের কাজ শেষ করে অবসর সময়ে নানা সুখ-দুঃখের আলাপচারিতা আর জমানো গল্পের আসরেই চলে তাদের রকমারি হাতের কাজ। ওদেরই নিপুন হাতের ছোঁয়া আর সুতা ও ক্রুশ কাটা এই দু’য়ের মিলিত বন্ধনেই তৈরি হচ্ছে রং-বে-রংয়ের রকমারি টুপি। এদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা নিজের হাত খরচ মজাতেও তৈরী করছে টুপি। এতে মাসে তাদের ১৫শ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত এক একজন আয় করে।
জানা যায়, বগুড়ার শেরপুরের, কাশিয়াবালা, তালপুকুরিয়া, চকধলী, জয়লা-জুয়ান, জয়লা-আলাদি, কল্যাণী, চক-কল্যাণী ও গুয়াগাছী এবং ধুনটের বোহালগাছা, চৌকিবাড়ি, ফড়িংহাটা, কুড়হা-হাটা, বিশ্বহরিগাছা, চাঁনদার, ভূবনগাতি, চালাপাড়া, পাঁচথুপি, থেউকান্দি ও বাটিকাবাড়ি সহ এই দুই উপজেলায় ৬শ পরিবার এই টুপি শিল্পের সঙ্গে জরিত। ব্যাপরী রাজু আকন্দ জানান, ৫ লক্ষ নারী এ পেশার সঙ্গে জড়িত রয়েছে। প্রতিবারের ন্যায় এবারো ঈদকে সামনে রেখে এ পেশায় আরো কয়েক হাজার নারী-পুরুষের আগমন ঘটেছে।
ওইসব রকমারি টুপি দেশের সীমানা পেরিয়ে আজ সূদুর সৌদি আরব, পাকিস্থান, দুবাই, কাতার, ভারতসহ মুসলিম সকল দেশেই প্রায় রপ্তানি হয়। বেশ কয়েকটি দেশে সুনাম কুড়িয়ে আনছে বগুড়ার শেরপুরে তৈরীকৃত জালি টুপি। এই সকল টুপি তৈরির সঙ্গে জরিত ৫ লক্ষাধিক নারী শ্রমিক ও শিক্ষার্থী এবং প্রায় ২শ ব্যাপারি।
এই জালি টুপি থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা বৈদেশিক অর্থ আয় হয়। সেই সাথে ওদের ভাগ্যের সঙ্গে দেশীয় অর্থনীতির চাকাও বেশ জোরোসোরেই ঘুরে। কিন্তু এ বছর সুতার দাম বেশি থাকায় চাহিদামত উৎপাদন হচ্ছেনা টুপি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খানপুর ইউনিয়নের তালপুকুরিয়া গ্রামের শানু খাতুন, আলেয়া, মর্জিনা বিবি, জানান, তারা জন্মের পর থেকেই নিজেকে টুপি বানানোর পেশার সঙ্গে যুক্ত। তাদের মতে, বাড়িতে কর্মহীন হয়ে বসে থাকার চেয়ে কিছু একটা করাই ভাল। এমন ভাবনা এবং বংশীয় ঐতিহ্যকে ধারন করতেই অনেকেই টুপি তৈরির শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।
ছাতিয়ানি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর মিম সুলতানাসহ সাবিনা ইয়াসমিন, সুর্বনা ও শিউলি জানান, জানান, তারা স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি টুপি তৈরি করে। দিনে ১টি করে টুপি তৈরী করে। সেই টুপি ২৫টাকায় বিক্রয় করা হয়। তারা আরো জানান, ৭৫টাকার সুতা দিয়ে ৮ থেকে ৯টি টুপি তৈরী হয়। আগে যে সুতার দাম ছিল ৬০ টাকা এখন সেই সুতা ৭৫টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে তাদের।
কাশিয়াবালা গ্রামের গৃহবধূ ফরিদা পারভিন, শিউলি খাতুন, রুমি, জোৎনা, আছিয়া, এছাড়া গ্রামের গৃহবধূরা সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে টুপি বানিয়ে থাকেন। তা থেকে আয়ও মন্দ হয়না। বিশেষ করে রমযানে গ্রামে গ্রামে টুপি তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। সবকিছু বাদ দিয়ে গৃহবধূরা টুপি তৈরির কাজ করেন। এ সময় বাড়ির অন্যান্যরাও বাদ থাকেন না। তারা কোন না কোন ভাবে ওই কাজে সহযোগিতা করেন। তারা জানান, বিভিন্ন এলাকার ব্যাপারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সূতো দিয়ে আসেন। পরে সূতোর দাম কেটে রেখে অবশিষ্ট টাকা দিয়ে টুপি কেনেন।
ব্যাপারী মোঃ সোহাগ জানান, ঠিকমত কাজ করলে দিনে সর্বোচ্চ ৩/৪টি টুপি বুনোনো সম্ভব। ৭০ টাকা দামের এক ববিন সূতা দিয়ে ১২টি টুপি তৈরি করে যার দাম ৪০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। ব্যাপারীরা বাড়িতে গিয়ে সূতার ববিন দিয়ে আসেন এবং টুপি তৈরি শেষ হলে নিজেরাই খরিদ করে থাকেন। ওইসব রকমারি টুপি বিভিন্ন মুসলিম দেশে বিক্রি হয়।
বাংলাদেশ জালি টুপি এ্যাসেসিয়েশনের বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি জুয়েল আকন্দ বলেন, প্রতি বছর প্রায় আমরা ৫০ কোটি টাকার অধিক বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনি। করোনার কারনে ব্যবসা থমে গেলেও এবার “তাহফিজ টুপি” প্রচুর চাহিদা বাজারে আমরা এর চাহিদা মেটাতে পারছিনা।
তবে আমরা সরকার থেকে কোন অনুদান বা কোন সহযোগিতাও পায়না। এই শিল্পকে টিকে রাখতে হলে সরকারকে পাশে দাঁড়াতে হবে। তাছাড়া এই শিল্প ধ্বংস হবে। কোটি কোটি টাকা প্রতি বছর রাজস্ব খাত হতে বি ত হবে।