ঢাকার বাইরে থেকে রাজধানীতে আসা মানুষের প্রায় সবার ইচ্ছা থাকে গুলিস্তানে গিয়ে একটা ঢুঁ মারা। সেখানে আছে কম দামে হরেক পণ্য কেনার সুযোগ। নতুন জিনিসের পাশাপাশি মেলে পুরনো, এমনকি চোরাই পণ্যও। তার জন্য আছে পণ্যভিত্তিক হাট। তেমনই হাট আছে চোরাই মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার-ল্যাপটপের। এই চোরাই মোবাইল ফোনের হাট এমনই বেপরোয়া যে, নগর ভবন থেকে পুলিশ সদর দপ্তরের গেট পর্যন্ত পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা।
গুলিস্তানে সারা ঢাকা শহরের চোরাই মোবাইল, ল্যাপটপসহ সব ধরনের ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক পণ্যের চোরাই হাটের কথা সুবিদিত। আবার এখানে পকেটমার, অজ্ঞান পার্টি আর প্রতারণার ঘটনাও আকছার ঘটে। তাই এ ব্যাপারে গুলিস্তানে মাইকিং করে সতর্ক করা হয় পথচারীদের, যা ঢাকা শহরের আরও কোথাও নেই।
এই প্রতিবেদক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সরেজমিনে ঘুরে আসেন চোরাই মোবাইল ফোনের হাট। গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মসজিদের মুখ থেকে নগর ভবন ছাড়িয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের গেট পর্যন্ত বিস্তৃত এই হাট। সন্ধ্যার পরে ফুটপাতজুড়ে এই হাট ঝলমল করে। প্রতিটি দোকানে রয়েছে লাইটিংয়ের সুবিধাসহ একাধিক মোবাইল চার্জের ব্যবস্থা।
ওসমানী উদ্যানের দক্ষিণ পাশের ফুটপাতে আছে ৭২টি অস্থায়ী দোকান। স্টেডিয়াম মার্কেটের পাশে আরও ১৭টি দোকানে সাজানো চোরাই মোবাইল ফোন। এসব হাটে আরও আছে মোবাইল ফোন মেরামতের ব্যবস্থা। সম্প্রতি এসব চোরাই মোবাইল ফোনের দোকানগুলোতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আগে বড় বড় ট্রাংক নিয়ে তাদের বসতে দেখা যেত। এখন তারা বসেন ছোট কাঠের টেবিল নিয়ে।
এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য পুলিশ-র্যাবের অভিযান থেকে বাঁচতে দ্রুত সটকে পড়ার সুবিধা। আলমগীর নামের একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘হুটহাট করে পুলিশ-র্যাব আসে, অভিযান চালায়। সরে পড়তে দেরি হলে দোকানিদের কেউ কেউ আটক হয়। এই জন্য ব্যবসায়ীরা ১০-১৫টি মোবাইল ফোন নিয়ে বসেন। পুলিশ-র্যাব আসতে দেখলে সবাই সেটগুলো পকেটে নিয়ে নিজেদের আড়াল করেন।’
গুলিস্তানের যে দুই জায়গায় ভ্রাম্যমাণ এই চোরাই মোবাইল ফোনের হাট বসে, সেই এলাকায় সব সময় পুলিশের প্রহরা, আর নগর কর্মকর্তাদের পদচারণ হামেশাই। সেই স্থানে এমন অবৈধ চোরাই মোবাইল ফোনের হাট! অবাক চোখে দেখেন এদিকে ঘুরতে আসা লোকজন।
গুলিস্তানের এই চোরাই হাটে নামীদামি ব্র্যান্ডের উচ্চমূল্যের মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। আইফোন টেন প্লাস থেকে শুরু করে স্যামসাং, সিমফনি, লাভা, ওপপো, নোকিয়াসহ সব ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন, ল্যাপটপসহ মোবাইল ফোনের পার্স মেলে।
নামে মোবাইল ফোনের হাট হলেও এখানে পাওয়া যায় ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক আর নানা পণ্য। কম্পিউটারের মনিটর, ব্র্যান্ডের ক্যামেরা, ড্রিল মেশিন, ইস্ত্রি, টেলিফোন, সাউন্ড বক্স, চার্জার লাইট, টেপরেকর্ডার, চুলে হিট করা মেশিন, ট্রিপট, বৈদ্যুতিক বাল্ব, সিলিং ফ্যান, টিভির রিমোট, মালটিপ্লাক, মোবাইল ফোন ও কম্পিউটারের কর্ট। এমনকি ডাক্তারি যন্ত্রপাতিও মেলে এই অবৈধ হাটে।
গুলিস্তানের স্টেডিয়াম ও ওসমানী উদ্যানের দক্ষিণ পাশে ফুটপাতে বসা এই চোরাই পণ্যের হাটে ভিড় করে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। ফলে ফুটপাতে পথ না পেয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটেন পথচারীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, পার্কের পাশ দিয়ে পথচারীদের বসার সব টুল ক্রেতা-বিক্রেতাদের দখলে। এখানে টুলে বসে বিশ্রাম নেওয়া তো দূরের কথা, দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই। এই চোরাই হাটে কিছু দোকানিকে দেখা গেছে ভালো মোবাইল ফোন এনে দেবে বলে আগাম (বায়না) টাকা নিতে। কিন্তু কোথা থেকে আসবে তা জানানো হয় না ক্রেতাকে।
কয়েকজন চোরাই মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা শহরের যেখানেই মোবাইল, ল্যাপটপসহ দামি জিনিস চুরি হোক, তার বেশির ভাগ চলে আসে গুলিস্তানের এসব ফুটপাতের হাটে।
চোরাই হাটের এক চা বিক্রেতা ঢাকা টাইমসকে জানান, প্রায় চার বছর ধরে এখানে বসছেন তিনি। এখানে কেউ ফ্রি ব্যবসা করতে পারে না। সবাইকে দৈনিক চাঁদা দিতে হয়। নিয়মিত চাঁদা দিলে নিরাপত্তা, বিদ্যু’ থেকে শুরু করে সব সেবা মেলে সহজেই।
এক ভুক্তভোগী ঢাকা টাইমসকে বলেন, এখানে সবাই গ্রুপিং করে ব্যবসা করেন। কয়েকজন মিলে কয়েকটা দোকান বসান। পালা করে দোকান চালান। একেক দিন একেকজন একেক দোকানে বসেন। এখানের মোবাইল ফোনসহ কোনো জিনিসের গ্যারান্টি নেই। টাকা দিয়ে পণ্য বুঝে নেওয়ার পর তার আর দায়ভার দোকানদার নেবে না। পণ্য কিনে দোকানের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায়ও পণ্যটি নিয়ে ক্রেতার কোনো অভিযোগ আমলে নেবে না, এমনকি অস্বীকারও করবে তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ক্রেতা বলেন, ‘এখানে অনেক দামি ও ভালো মানের মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য পণ্য পাওয়া যায়। আমি এর আগে এখান থেকে মোবাইল কিনেছি, সেটা ভালো চলছে। আজ বন্ধুর জন্য একটা মোবাইল কিনতে এসেছি। এরা মাস্টার কপির সঙ্গে এই মোবাইল বিক্রি করে। একটু দেখে কিনলে ভালো মোবাইল ফোন পাওয়া যায়।’
এই হাটে মোবাইল ফোন কোথা থেকে আসে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বিক্রেতা বলেন, ‘আমরা চোরাই মোবাইলগুলো পায় বিভিন্ন জনের মাধ্যমে। তারা এখানে এসে দিয়ে যায়। আমরা কোথাও গিয়ে নিয়ে আসি না। আর মাস্টার কপি মোবাইলগুলো আনি হাতিরপুলের মোতালেব প্লাজার কিছু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। তারা আমাদের কাছ থেকে তাদের কেনা দাম নেয়।’ ’
গুলিস্তানের এই হাটে বসার জন্য প্রতিদিন প্রতি দোকানির ১০০ টাকা করে দিতে হয় বলে জানান ওই বিক্রেতা। বলেন, ‘আর সন্ধ্যার পর লাইট জ্বালানোর জন্য দিতে হয় ২০ টাকা। বিদ্যুৎ আসে অন্য পথে। সিটি করপোরেশন থেকে এখানে বিদ্যুতের লাইন আসেনি।’
জানা গেছে, চাঁদা তোলার জন্য আলাদা লোক আছে। তারা নিয়মিত সন্ধ্যা সাতটায় এসে চাঁদা তুলে নিয়ে যায়। এই চাঁদার টাকার ভাগ পায় এলাকার রাজনৈতিক নেতাসহ স্থানীয় পুলিশ।
এই অবৈধ হাট বন্ধ করতে পুলিশ প্রায়ই অভিযান চালায় বলে জানান রমনা বিভাগের (রমনা জোন) এডিসি হারুন অর রশিদ। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, `এখানে অভিযান চালিয়ে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সম্প্রতি। এখন আবার তারা বসছে। শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ না পেলে অভিযান চালাতে পারি না। তবে ঢাকা জেলা প্রশাসন ও বিটিসিএল এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই কাজে র্যাবের সহযোগিতা প্রয়োজন হলে, সেটা দেওয়ার জন্য র্যাব প্রস্তুত আছে।’
সূত্র : ঢাকা টাইমস