করোনার এই মহামারিতে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে নিজের বেতন ও বোনাসের টাকা দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের নতুন পাঞ্জাবি, টুপি, জায়নামাজ, সুরমা, আতর উপহার দিয়েছেন এক নার্স। নার্সের দেয়া এসব উপহারসামগ্রী পেয়ে হাসপাতালে ঈদ উদযাপন করেন রোগীরা।
ব্যতিক্রমী এই কাজটি করেছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স দেলোয়ারা বেগম। তিনি ২০ বছর ধরে হৃদরোগ বিভাগের সিসিইউতে (করোনারি কেয়ার ইউনিট) সেবা দিয়ে আসছেন।
শুক্রবার (১৪ মে) বেলা ১১টার দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সিসিইউতে গিয়ে দেখা যায়, নার্স দেলোয়ারা বেগম রোগীদের নতুন পাঞ্জাবি, টুপি, জায়নামাজ, সুরমা ও আতর পৌঁছে দিচ্ছেন। এসময় তার সহকর্মী ও ওয়ার্ডের সিকিরিউটি গার্ড উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে বুধবার ও বৃহস্পতিবারও রোগীদের মাঝে এসব উপহারসামগ্রী বিতরণ করেন নার্স দেলোয়ারা বেগম। তিনদিনে তিনি ওই ওয়ার্ডের ৬০ জন রোগীর জন্য ঈদ উপহার কিনে দেন।
কেন এমন উদ্যোগ নিয়েছেন জানতে চাইলে দেলোয়ারা বেগম জাগো নিউজকে জানান, এই ওয়ার্ডে যেসব রোগী ভর্তি থাকেন তাদের বেশিরভাগই প্রবীণ। তাদের মাঝে তিনি তার পল্লী চিকিৎসক বাবাকে খুঁজে বেড়ান।
কৈশোরে বাবাকে হারানোর পর ২০১৯ সালে মাকেও হারান। এরপর থেকে তিনি মনস্থির করেন, প্রতি ঈদে রোগীদের উপহার প্রদান করবেন। গত বছর স্বল্প পরিসরে করলেও এবার তার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ বিষয়ে কথা হয় ওই ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা নেত্রকোনা সদর উপজেলার কুতুবপুর গ্রামের আব্দুল মান্নানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গত ১১-১২ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছি। এরই মাঝে ঈদ চলে আসল।
ঈদের উপহার হিসেবে নার্স দেলোয়ারা বেগম আমাকে পাঞ্জাবি, টুপি, আতর, সুরমা, জায়নামাজ কিনে দিয়েছেন। পাঞ্জাবি, টুপি পরে জায়নামাজে বসে উনার জন্য দোয়া করেছি।’
একই জেলার সদর উপজেলার নিজামপুর গ্রামের বাসিন্দা মোস্তফা মিয়া (৬০)। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বুধবার থেকে আজ পর্যন্ত দেলোয়ারা বেগম এই ওয়ার্ডের সব রোগীর মাঝে ঈদ উপহার বিতরণ করছেন। তিনি নিয়মিত আমাদের সেবা করে যাচ্ছেন। যে ঋণ কোনোদিন শোধ হওয়ার নয়।
ফারুক মিয়া (৫৫) নামের আরেক রোগী বলেন, ‘এই প্রথম দেখলাম হাসপাতালে সেবা করার পাশাপাশি ঈদ উপহার দেয়। তবে, আমি দোয়া করি তার মনের আশা পূরণ হোক।’
সিনিয়র স্টাফ নার্স দেলোয়ারা বেগমের সহকর্মী সিনিয়র নার্স জয়ন্তী বলেন, তার এই উদ্যোগ জিনিয়রদের অনুপ্রেরণা। তার জন্য আজ আমরা গর্বিত।
এ বিষয়ে সিনিয়র স্টাফ নার্স দেলোয়ারা বেগম বলেন, ‘নিজের ঈদ বোনাস আর জমানো টাকা দিয়ে রোগীদের জন্য কেনাকাটা করে ঈদ উপহার দিয়েছি। এ কাজে আমার পরিবার সহাযতা করেছে। এক ছেলে ও এক মেয়ে আমাকে এমন কাজ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।’
তিনি বলেন, ঈদের সময় বেশিরভাগ রোগীই ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। যেসব রোগীর অবস্থা গুরুতর, তারাই শুধু হাসপাতালে ভর্তি থাকেন।
ঈদের দিন তাদের হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে-বসে সময় কাটানো ছাড়া কিছু করার থাকে না। রোগীদের মন পড়ে থাকে তার বাড়িতে। তারা যেন মন খারাপ বা পরিবারের লোকের কথা মনে না করেন, সেজন্য এমন উদ্যোগ নিয়েছি। প্রতিবছর এটা অব্যাহত রাখতে চান এই নার্স।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট কৌশিক ভৌমিক বলেন, আমরা এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। কারণ, তার এ কাজ আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান গণপতি আদিত্য বলেন, এটা অবশ্যই একটি মানবিক কাজ। পেশাগত দায়িত্ব পালন ছাড়াও নিজ উদ্যোগে সবাইকে ঈদ উপহার দিয়ে তিনি অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। তার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। প্রতিটি ওয়ার্ডেই প্রচুর রোগীর চাপ থাকে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ছয় জেলা ছাড়াও সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রাম ও গাজীপুর জেলার বেশ কিছু এলাকা থেকেও এই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন রোগীরা।