পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে দুটি ‘মানবিক’ বিয়ের গল্প শোনালেন মামুনুল

হেফাজত ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক মামুনুল হককে সাত দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ। ডিবি কার্যালয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দিনের মুখ খুলতে শুরু করেছেন মামুনুল হক।

জিজ্ঞাসাবাদে মামুনুল স্বীকার করেন প্রথম বিয়ের পর মানবিক খাতিরে দুই জান্নাতকেই কন্ট্রাক্টচ্যুয়াল (চুক্তিভিত্তিক) বিয়ে করেছিলেন তিনি। এসব বিয়ের সময় কারা সাক্ষী ছিলেন তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদের পরিকল্পনা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, মামুনুল হক মানবিক বিয়ের গল্প বানালেও পরের দুই নারীকে বিয়েই করেননি। শুধু স্ত্রীর মতো আচরণ করার জন্য চুক্তি করেছিলেন তিনি। এর জন্য দেয়া হত ভরণপোষণ। গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এমন কথা বলেছেন মামুনুল হক। ইসলামি চিন্তাবিদরা বলছেন, এ ধরনের বিয়ের কোনো ভিত্তি নেই ইসলামে।

গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে একটি রিসোর্টে নারীসহ ধরা পড়েন মামুনুল হক। তখন তিনি দাবি করেন, ওই নারী তার বিবাহিতা দ্বিতীয় স্ত্রী। পরে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ফোনালাপ ফাঁস হয় মামুনুল হকের। যেখানে বলা হয়, ওই নারী হাফেজ শহীদুলের বউ। জনরোষ থেকে বাঁচতেই দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে সেদিন পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি।

মামুনুল হকের এমন মানবিক বিয়ে নিয়ে যখন আলোচনা চলছে তখন দৃশ্যপটে হাজির আরেক নারীর ভাই। তার দাবি, তিনি তার বোন জান্নাতুল ফেরদৌস লিপিকে খুঁজে পাচ্ছেন না। এজন্য মামুনুলের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় একটি জিডিও করেছেন। যার তদন্ত করছে পুলিশ।

অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা দিতেই দুই ডিভোর্সি নারীকে বিয়ে করেছিলেন বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে দাবি করেছেন মামুনুল। বলেছেন, রিসোর্টকাণ্ডের শুরুতেই স্বীকার করলে প্রথম স্ত্রী আমেনা তৈয়বা বড় ধরনের কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতেন বলে তার ধারণা ছিল। এ কারণে তৎক্ষণাৎ স্বীকার করেননি। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দিনই অন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্যের সঙ্গে এসব কথা বলেছেন মামুনুল।

একই সঙ্গে রিমান্ডে তাকে সহিংসতায় উসকানি দেয়ার অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়েও ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানা গেছে।

সোমবার আদালতের নির্দেশে মামুনুল হককে সাত দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, মামুনুলকে নিরাপত্তার স্বার্থেই কেবল গোয়েন্দা কার্যালয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে আমার অফিসাররা গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।

তিনি আরো বলেন, এখন পর্যন্ত মামুনুল প্রথম বিয়ে ছাড়া বাকি দুই বিয়ের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। এমনকি বিয়ের সাক্ষীদের নাম প্রকাশের ব্যাপারেও গড়িমসি করছেন। দ্বিতীয় জান্নাতের ভাই শাহজাহানের জিডি নিয়ে আমরা কাজ করছি।

ইসলামী চিন্তাবিদ ড. আহমদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, এটা ইসলামের দৃষ্টিতে সাধারণ কোনো বিয়েও না বা নিকাহ মুতা যেটি আহলে সুন্নতের জামাতের মধ্যে হারাম, শীরাহসহ কিছু সংখ্যক মুসলিমদের মতে, নিকাহ মুতা বৈধ, এই যে তথ্য আমরা পেয়েছি তা কিন্তু নিকাহের মধ্যেও পড়ে না।

ইসলামী চিন্তাবিদরা আরো বলছেন, ইসলামী শরিয়তেও মুতা বিয়ে নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। কারো কারো মতে নির্দিষ্ট সময় এবং দেনমোহর পরিশোধ করে মুতা বিয়ে করা যায়। কিন্তু মামুনুলের এমন চুক্তি এ বিয়ের শর্তপূরণ করে না।

ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, যে দুই নারীর নাম বেরিয়ে আসছে, তাদের সঙ্গে মামুনুল হক দীর্ঘদিন ধরে স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বসবাস করে আসছেন। একইসঙ্গে তার স্ত্রী দাবিকারী এক জান্নাতের নিকটাত্মীয়ের করা জিডির সূত্র ধরে তার কাছে জানতে চাইলে মামুনুল এ সময় মুখ বুজে থাকেন। কোনো উত্তর দেননি। পাশাপাশি ওই দুই নারী ডিভোর্সি হওয়ায় তাদের দিকে মানবিকভাবে তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন বলেও জানিয়েছেন মামুনুল হক। এর মধ্যে একজনকে মোহাম্মদপুরের একটি মাদ্রাসায় চাকরিও দিয়েছেন।

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, কাগজপত্র না থাকলে কিভাবে বিয়ে হলো? এমন প্রশ্নে গোয়েন্দাদের মামুনুল হক জানিয়েছেন, তাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন বসবাস করলেও বিয়ের কাবিন করেননি। আর এ কারণেই কোনো কাবিননামাও নেই। তাদের দিকে মানবিক দৃষ্টি দিয়েছিলেন তিনি। ওই নারীদের আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনাই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য। সেভাবেই তাদের সাপোর্ট করে আসছিলেন তিনি।

মাহবুব আলম বলেন, ইসলাম তো দাঙ্গা, সংঘাত, সহিংসতা ও নাশকতার কথা বলেনি, তাহলে কেন হেফাজতে ইসলাম এগুলো করছে? এমন প্রশ্নে মামুনুল হক বলেন- সংগঠনের নেতা হিসেবে আমার ওপর দায় আসে। হেফাজত ছাড়া অন্য কোনো সংগঠনও সংঘাতে জড়ায়। আমাদের বেলায় তেমনটি হতে পারে। তবে, তিনি এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত কি না, সে বিষয়ে মুখ খোলেননি।

২০১৩ সালে হেফাজত ইসলাম তাণ্ডব চালিয়ে পবিত্র কোরআন শরিফে আগুন ধরিয়ে দেয়া ছাড়াও জানমালের ক্ষতি করে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মামুনুল হক কোনো উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যান। একই সঙ্গে তাকে হেফাজতে ইসলামের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দেননি। তবে মোহাম্মদপুর থানার মামলার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেন, যখন তাবলীগ জামাতের দুটি গ্রুপ সাদ ও জুবায়েরপন্থী মারামারি হয়েছিল, তিনি সেদিন জুবায়েরপন্থী ছিলেন। তবে এ ঘটনায় কোনো হতাহত হয়েছিল কি না তা তার জানা নেই বলে দাবি করেন মামুনুল হক।

উল্লেখ‌্য, রোববার দুপুরে মোহাম্মদপুর রহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে মামুনুল হককে গ্রেফতার করা হয়। এরপরই তার বিরুদ্ধে একে একে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বেরিয়ে আসছে। মোহাম্মদপুর থানার মারামারি মামলায় তাকে ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে তাকে মিন্টু রোডে গোয়েন্দা কার্যালয়ে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

মূলত নারায়ণগঞ্জের রয়েল রিসোর্টের নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা থেকে মামুনুলের অবৈধ সম্পর্ক, লাম্পট্য, ব্যভিচার, একাধিক বিয়ে, প্রেম ইত্যাদি সবার সামনে আসে। তখন থেকেই তার এই বিষয়ে একের পর এক ফোনালাপ ফাঁস, দ্বিতীয় স্ত্রীর বড় ছেলের অনলাইন বক্তব্যসহ নানা বিষয়ে তার সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হতে থাকে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও তার এই ধরনের বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ নিয়ে নানা ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য পায়। ফলে সবকিছু মানুষের সামনে আসতে থাকে।

প্রথমে মামুনুল বলেছিলেন যে, ঝর্ণা তার দ্বিতীয় স্ত্রী এবং শরিয়ত সম্মত উপায়ে তিনি তাকে বিয়ে করেছেন। কিন্তু ঝর্ণার ডায়েরি এবং তার কথাবার্তা থেকে স্পষ্ট হওয়া যায় যে তিনি জান্নাত ওরফে ঝর্ণাকে আসলে বিয়েই করেননি বরং তার সাথে প্রতারণা করেছেন। মামুনুলের আরো এক স্ত্রীর সন্ধান পাওয়া যায় পরে। সেও মামুনুলের স্ত্রী বলে কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাতের ভাই দাবি করেন এবং ২০২০ সালে অর্থাৎ গত বছর তাদের বিয়ে হয়েছে বলেও তার ভাই দাবি করেন। এখন পর্যন্ত মামুনুলের তিনটি স্ত্রীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়াও মামুনুল একাধিক নারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে এবং তাদের সাথে মামুনুলের সম্পর্ক আছে এমন কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক এত বড় একটি দায়িত্বশীল পদে থেকে এই ধরনের লাম্পট্য, ব্যভিচার করেছেন যেটা সমাজে একটি খারাপ বার্তা দেয়। হেফাজতের প্রতি মানুষের সহানুভূতির জায়গাটি মামুনুল হকে তার এই কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শেষ করে দিয়েছেন। এখন তার সম্পর্কে মানুষের ধারণা শুধুই একজন লম্পট হিসেবে। যার কোনো স্থান সাধারণ মানুষের কাছে নেই। আসলে মামুনুলের মতো লোকেরা ধর্মকে সামনে রেখে সাধারণ মানুষের সহানুভূতির জায়গা তৈরি করে আর তলে তলে যত ধরনের খারাপ কাজ রয়েছে তারা সব কিছুই করে। কোনো অবৈধ কাজ করতে গিয়ে ধরা খেলে, মাদ্রাসার নিরীহ শিক্ষার্থীদের লেলিয়ে দিয়ে সেখান থেকে ছাড়া পায়। যেমনটি ঘটেছিল নারায়ণগঞ্জের রয়েল রিসোর্টে।

সূত্রঃ ডেইলি বাংলাদেশ