পর পর মা’রা গেল বাবা-মা দুইজনেই, কাঁ’দছে অস’হায় কিশোরী

মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে মে’য়েটার জীবনটাই পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। বাবাকে হা’রানোর পরে যখন শুধু মাকে আঁকড়ে নতুন করে বাঁ’চার স্বপ্ন দে’খতে শুরু করেছিল সে, তখনই এক দুর্ঘ’টনায় মায়ের মৃ’ত্যু সবটাই ওলটপালট করে দিল। ১৩ বছরের লক্ষ্মী সরকারের ভবিষ্যৎ এখন এতটাই অনি’শ্চিত যে, সে কথা ভাবতে গিয়ে বুক কাঁ’পছে প্রতিবেশীদেরও।

গত মঙ্গলবার রাতে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতা’লের সামনে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃ’ত্যু হয় সেখানকারই আয়া মুন্নি সরকারের। দু’টি বাসের রেষারেষির জে’রেই এমন ঘ’টনা বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের অ’ভিযোগ। জা’না যায়, গত অক্টোবরেই মৃ’ত্যু হয়েছিল মুন্নির স্বামী রাজেশ সরকারের। দাদের সংক্র’মণ থেকে পচন ধ’রেছিল তাঁর শ’রীরে। রাজেশ আর মুন্নির বছর তেরোর মে’য়ে লক্ষ্মী এখন অ’ভিভাবকহীন। দম’দম রোডে ভাড়া বাড়িতে প্রতিবেশীরা তাকে আপাতত আগলে রাখলেও তাঁদের প্রশ্ন, কত দিন? ওই বাড়ির এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘কয়েক দিন মায়াদয়া থেকে লোকে দেখবে। তার পরে? পু’লিশ জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডে বাচ্চাটার জন্য একটা আবেদন জা’নাবে বলেছে। ভাল কোনও হোমে রেখে ওর পড়াশোনার ব্যব’স্থা হলে খুব ভাল হয়। না হলে ভবিষ্যৎটাই শেষ হয়ে যাবে।’’

পাঁচ মাস এক দিনের ব্যবধানে বাবা এবং মাকে হা’রানো বালিকা বলে, ‘‘বাবা শয্যাশা’য়ী ছিল। ঠাকুর দে’খতে বেরোলে যদি করো’না নিয়ে ফিরি, সেই ভেবে গত পুজোয় এক দিনও বেরোইনি। নবমীর দিন পাড়ার ব’ন্ধুরা জো’র করল, সকলে মিলে চাউমিন খেতে যাবে বলে। মা হাত খরচের টাকা দিয়ে রেখেছিল। রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। যাওয়া হয়নি। ওই দিনই তো বাবা মা’রা গেল।’’ গলা বুজে আসে মে’য়ের। খানিক সামলে নিয়ে সে বলে, ‘‘অনেক দিন থেকে বলছি, নাচ শিখব। মা বলেছিল, হাতে একটু টাকা এলেই নাচের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে। হাসপাতা’লে কাজে গিয়ে মা-ও আর ফিরল না!’’

দম’দম রোডে লক্ষ্মীদের বাড়িতে ভাড়াটেদের বারো ঘরের সামনে এক উঠোন। ওই ভাড়ার ঘরের একটি— লক্ষ্মীদের টালির চাল যেন নুইয়ে মাটিতে মিশে যেতে চাইছে। ঘর লাগোয়া চিলতে উঠোনেই ছিল লক্ষ্মীর মা মুন্নিদেবীর রান্নাঘর। ঘরের এক দিকে চৌকি পাতা। এ ছাড়া ঘরে বিশেষ আসবাব নেই। চৌকির তোশকও পাতলা হয়ে বহু জায়গায় ছিঁড়ে এসেছে। চৌকির পায়ার এক দিক ধ’রে বসে পড়ে পঞ্চ’ম শ্রেণির ছা’ত্রী বলে, ‘‘আমি এখানেইথাকতে চাই। এই ঘরে বাবা-মায়ের স’ঙ্গে কত স্মৃ’তি! পড়াশোনা করে চাকরি ক’রতে চাই। বাবা-মা যেখানেই থাকুক, সেটা দেখে শান্তি পাবে, আমি জানি।’’

কি’শোরী বলে চলে, গত জানুয়ারিতে মায়ের স’ঙ্গে সে দক্ষিণেশ্বরে গিয়েছিল। মা-মে’য়ের সেটাই শেষ বার একস’ঙ্গে ঘুরতে যাওয়া। বাবা-মা আর সে শেষ ঘুরতে গিয়েছিল ইকো’পার্কে। তার পর থেকেই তার বাবা শয্যাশা’য়ী হয়ে পড়েন। ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেন, বিরিয়ানি খেতে খুব ভালবাসে সে। অনেক দিন খাওয়া হয়নি সে সব। কারণ, মা বলেছিলেন, টাকা হাতে এলে রেঁধে দেবেন। মায়ের মৃ’ত্যুর পরে প্রতিবেশীদের দেওয়া ফল আর মিষ্টি খেয়েই দিন কাটছে। লক্ষ্মী বলে, ‘‘বিরিয়ানির কথা মনে হলেই বাবার কথা মনে পড়ে। বাবার অ’সু’স্থতা তখন অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। তবু হাঁটাচলা ক’রতে পারত। আমা’র জন্য বিরিয়ানি কিনে এনেছিল। মা বলেছিল, টাকা
কোথায় পেলে? বাবা হেসে বলেছিল, তুমিই তো হাত খরচ দিয়েছিলে। নিজে’র হাত খরচের টাকা দিয়ে বাবা আমা’র জন্য বিরিয়ানি কিনে এনেছিল।’’

বাবা আদর করে ডাকতেন ‘সোনা মে’য়ে’। মায়ের কাছে ছিল ‘দুলু’। আর ব’ন্ধুরা তাকে ডাকে রানি নামে। লক্ষ্মী বলে, ‘‘সব নামের মধ্যে সোনা মে’য়ে ডাকটা খুব কাছের। মায়ের চেয়েও আমি বাবাকে বেশি ভালবাসি।’’ কেন? ‘‘বাবা শয্যাশা’য়ী হয়ে পড়ার পর থেকে মাকেই কাজে যেতে হত। বাবাকে সর্বক্ষণ আমি দেখতাম। আর বাবা আমাকে।’’কিন্তু এ বার তাকে দেখবে কে? এই প্রশ্নের উত্তর হাতড়ে বেড়াচ্ছেন তার প্রতিবেশীরাও।