বিয়ের নামে বহু পুরুষকে ফাঁদে ফেলে অর্থ-সম্পদ লুট, প্রতারণা-জালিয়াতি ও নিরীহ লোকদের মামলায় ফেলে হয়রানিসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ উঠেছে খুলনার বহুল আলোচিত নারী সুলতানা পারভীন নীলা ওরফে বৃষ্টির বিরুদ্ধে। তার ফাঁদে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন একাধিক ব্যক্তি।
তার প্রতারণা ও জালিয়াতিসহ অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরে তাকে গ্রেফতার এবং কঠোর শাস্তির দাবিতে সোমবার (২২ মার্চ) দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মহানগরীর নাজিরঘাট এলাকার মৃত আব্দুল জলিলের ছেলে মো. আব্দুল বাকী।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, নগরীর সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার সুলতানুল আলম বাদলের মেয়ে সুলতানা পারভীন নীলা ওরফে সুলতানা পারভীন বৃষ্টি এ পর্যন্ত আট এর অধিক বিয়ে করেছেন। বিয়ে করে কিছুদিন পর সেই স্বামীকে ছেড়ে দেওয়া এবং তার কাছ থেকে দেনমোহরের টাকাসহ নানা কৌশলে বাড়ি-গাড়ি হাতিয়ে নেওয়াই তার ব্যবসা। তার মূল টার্গেট সম্পদশালী ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী ও প্রবাসী পুরুষ। প্রথমে টার্গেট নিশ্চিত করে তিনি ধীরে ধীরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে নিজ দেহের সৌন্দর্য ও কথা মালার মারপ্যাঁচে আটকে ফেলেন টার্গেটকৃত পুরুষদের।
সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়, ১৯৯৯ সালে সুলতানা পারভীনের প্রথম বিয়ে হয় মাদারীপুর জেলার হরিকুমারিয়া গ্রামের আলহাজ আব্দুল হাকিম শিকদারের জাপান প্রবাসী ছেলে শাহাবউদ্দিন সিকদারের সঙ্গে। নীলার বয়স ছিলো তখন ১৫ বছরেরও কম। কিছুদিন যেতে না যেতেই স্বামীর ঘর থেকে নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকার নিয়ে বেরিয়ে যায় তিনি। তার উশৃঙ্খল জীবনযাপন ও মালপত্র চুরির ঘটনায় শাহাবুদ্দিন মাদারীপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এর নম্বর-৭৩৮, তারিখ ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৯। যদিও ২০০১ সালে তার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে নীলার।
বৃষ্টির দ্বিতীয় বিয়ে হয় ২০০৫ সালের ৬ মে খুলনা মহানগরীর শেরেবাংলা রোডস্থ মো.মকবুল হোসেনের ছেলে এসএম মুনির হোসেনের সঙ্গে। তখন প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নিজেকে ‘কুমারী’ দাবি করে মুনির হোসেনের সঙ্গে এক লাখ টাকার কাবিননামায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। কিন্তু বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে নীলার উশৃংখল জীবনযাপন এবং ও উগ্র আচরণের শিকার হন স্বামী মুনির। একপর্যায়ে স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ অর্থ নিয়ে এ বাড়ি থেকেও বেরিয়ে যান নীলা। এ ঘটনায় একই বছরের ১০ ডিসেম্বর মুনির হোসেন তাকে তালাক দেন। যদিও পরবর্তীতে তার কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে সুলতানা পারভীন নীলা ২০০৬ সালে মনির হোসেনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করেন।
ওই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সুলতানা পারভীন প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে আবারও নিজেকে ‘কুমারী’ দাবি করে ২০০৮ সালের এপ্রিলে নগরীর খালিশপুর ওয়ারলেস ক্রস রোডের মৃত আলহাজ আব্দুল মান্নানের ছেলে ঠিকাদার মঈনুল আরেফিন বনিকে বিয়ে করেন। তবে, শর্ত থাকে বিয়ের পর নীলা তার আত্মীয়ের মাধ্যমে বনিকে ইতালি নিয়ে যাবে। শর্ত মোতাবেক বিয়ের পর তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই নীলার প্রতারণা প্রকাশ পেতে থাকে। একপর্যায়ে তাদের মধ্যেও বিচ্ছেদ ঘটে।
এ ঘটনায় নীলা নিজেকে কুমারী পরিচয় দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করায় স্বামী শেখ মঈনুল খুলনার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে নীলার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি এখন তদন্তাধীন রয়েছে। তবে, যথারীতি অর্থ আদায় করতে প্রতারক নীলা মঈনুলের বিরুদ্ধেও খুলনার বিভিন্ন আদালতে একাধিক মামলা দায়ের করেন। বনির সঙ্গে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় নীলা ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জের ইফতিখার নামে একজনকে বিয়ে করেন। সেখানেও দাম্পত্য জীবন স্থায়ী হয়নি তার। একপর্যায়ে ইফতেখার আমেরিকায় চলে যান।
২০১২ সালে নীলা বিয়ে করেন বাগেরহাটের বাসিন্দা কামাল হোসেনকে, ২০১৭ সালে ইতালি প্রবাসী মাদারীপুরের মোহাম্মদ আজিমকে, ২০১৮ সালে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মোহাম্মদ রহমানকে এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালে খুলনা মহানগরীর নাজির ঘাট এলাকার মো. আব্দুল বাকীর সঙ্গে (আমি) তার বিয়ে হয়। আমার সঙ্গেও প্রতারণা করায় আমি তার বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে চেক ও টাকা-পয়সা চুরির অভিযোগে মামলা দায়ের করেছি। মামলাটি এখন পিবিআই ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ কার্যালয়ে তদন্তাধীন রয়েছে। এছাড়াও সিরাজগঞ্জে অবস্থানকালীন ঢাকার একটি ফ্ল্যাট তার নামে লিখে না দেওয়ায় তিনি তার আরও এক স্বামীকে নারী নির্যাতন মামলায় ফাঁসানো এবং জীবন নাশের হুমকি দেয় । ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ২ মে সিরাজগঞ্জ সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়।
বৃষ্টি চলতি বছরের জানুয়ারিতে খুলনা মহানগরীর খালিশপুরে তার পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে আফরীন আহমেদ নামে এক আত্মীয়ের বাসায় কিছুদিন অবস্থান করেন। সেই সুযোগে আত্মীয়ের বাসা থেকে একটি চেকের পাতা চুরি করে আত্মীয়ের ব্যাংক একাউন্ট থেকে ১০ লাখ টাকা তুলে আত্মসাৎ করেন। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও চুরির অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। এই মামলাটি এখন পিবিআই খুলনা কার্যালয়ে তদন্তাধীন রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়, সুলতানা পারভীন নীলা কর্তৃক প্রতারণার শিকার তার এক স্বামী এস এম মহিবুর রহমান কর্তৃক অভিযোগের তদন্তে সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. স্নিগ্ধ আকতার গত বছরের ৩০ জানুয়ারি পুলিশ সুপার বরাবর দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, সুলতানা পারভীন নীলা নিজেকে কুমারী, বিধবা ও তালাকপ্রাপ্তা দাবি করে কখনো সুলতানা পারভীন নীলা, কখনো সুলতানা পারভীন বৃষ্টি, কখনো শুধুমাত্র সুলতানা পারভীন নাম ব্যবহার করে ইতোপূর্বে আরও পাঁচটি বিয়ে করেছিল।
এভাবে একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে কিছুদিন অতিবাহিত করার পর তাদের প্রতি জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার, মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বিগত প্রত্যেক স্বামী কর্তৃক তালাকপ্রাপ্ত হওয়ার পর তাদের বেকায়দায় ফেলতে তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও দায়ের করেছে। সাবেক স্বামীদের মধ্যে দুইজন অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মারা গেছে বলেও জানা যায়।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, খুলনা জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয় এর অনুমোদিত তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, সুলতানা পারভীনের নিকাহ রেজিস্ট্রিকারী মাওলানা এ এস এম নুরুল হক বৈধ নিবন্ধিত নিকাহ রেজিস্ট্রার নয়।
অবৈধ নিকাহ রেজিস্টার দ্বারা প্রতারণার মাধ্যমে বিবাহ সম্পাদিত করেন তিনি। বিয়ের পর সংসার পরিচালনার নামে অত্যন্ত সুকৌশলে নিজের খরচ বাবদ টাকা, দেনমোহরের টাকা এবং স্বামীর নামীয় ফ্ল্যাটবাড়ি নিজ নামে রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার জন্য স্বামীদের ওপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার নির্যাতন চালান। এমনকি বিয়ের কাবিননামায় টাকার অংক পরিবর্তন করে মোটা অংকের টাকা বসিয়ে দেন।
সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী আব্দুল বাকী বলেন, নীলার বিরুদ্ধে আরও একাধিক অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রতারণার মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। এ অবস্থায় তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ না নিলে তিনি এভাবে একের পর এক বহু পুরুষকে ফাঁদে ফেলে তাদের অর্থ-সম্পদ লুটে নেবে। অবিলম্বে তাকে গ্রেফতার পূর্বক তার সব অপকর্ম তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে সুলতানা পারভীন নীলা বলেন, বাকী আমাকে বিয়ে করেছেন প্রতারণা জালিয়াতি করে। তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে আমাকে বিয়ে করেন। পরে আমার কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আমার মামলা চলছে। বাকী যেসব অভিযোগ করেছেন সব মিথ্যা। আমার ভাগ্য খারাপ বলে চার বার বিয়ে হয়েছে।