কেরানি কন্যার ব্যাংক একাউন্টে ৭০ কোটি টাকার লেনদেন

বহুল আ’লোচিত প্রশান্ত কুমা’র (পি কে) হালদারের অর্থ পা’চারের অন্যতম সহযোগি ও তার বান্ধবী হিসেবে পরিচিত নাহিদা রুনাইয়ের ব্যাংক হিসাবে গত চার-পাঁচ বছরের মধ্যে ৭০ কোটি টাকারও বেশি লেনদেন করা হয়েছে। এছাড়া রুনাইয়ের কম করে হলেও ২৮ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পেয়েছে কমি’শনের দলটি; যা একটি সরকারি দপ্তরে ‘কেরানি পদ’-এ চাকরি করা বাবার অফিস এক্সিকিউটিভ মে’য়ের পক্ষে বৈ’ধভাবে অর্জন করা অসম্ভব বলেই মনে করছেন ত’দন্ত সংশ্লি’ষ্টরা।

নাহিদা রুনাই এখনো নিয়মিত অফিস করছেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে। পি কে হালদারের কমপক্ষে চারটি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ ক’রতেন তিনি। পি কে হালদারের বি’রুদ্ধে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ ও পা’চারের অ’ভিযোগ ত’দন্তকারী দুদক দলের সদস্যদের সাথে আলাপ করে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য জা’না গেছে। পি কে হালদারের অর্থ আত্মসাৎ ও পা’চারের বিষয়ে অনুসন্ধান ও ত’দন্ত করছে দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে চার সদস্যদের একটি দল।

অনুসন্ধানে জা’না গেছে, চট্টগ্রামের খুলশী থা’নার পূর্ব নাসিরাবাদ এলাকার জাকির হোসেন বাইলেন স্থা’য়ী ঠিকানার বাসিন্দা নাহিদা রুনাই। তাদের বাড়িটি স্থা’নীয়ভাবে মোজাফ্ফর খানের বাড়ি হিসেবে পরিচিত। রুনাইয়ের বাবার নাম মফিজুর রহমান। তিনি চট্টগ্রামে একটি সরকারি দপ্তরে ‘করণিক’ পদে চাকরি ক’রতেন। রুনাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষে জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় এসে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিডেটে চাকরি পান। সেখানেই ২০০৯ সাল থেকে ব্যব’স্থাপনা পরিচালক ছিলেন পি কে হালদার। ২০১১-১২ সালে পি কে হালদারের স’ঙ্গে পরিচয় হয় রুনাইয়ের। এরপর ঘনিষ্ঠতা। তারপর আর তাকে পেছনে ফি’রে তাকাতে হয়নি। শনৈ শনৈ উন্নতি হয় রুনাইয়ের। এসএমই লোন শাখার অফিস এক্সিকিউটিভ থেকে প্রতিষ্ঠান প্রধান পি কে হালদারের বান্ধবী ‘বড় আপা’ হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন পি কে হালদার।

পি কে হালদার রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে নাহিদা রুনাইকে নিয়ে আসেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে। দ্রুত সময়ে তাকে চারটি পদোন্নতি দিয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট করেন পি কে হালদার।দুদক ক’র্মক’র্তারা বলছেন, পি কের টাকা পা’চারের অন্যতম সহযোগী এই নাহিদা রুনাই। কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কত টাকা আত্মসাৎ ও পা’চার হচ্ছে সেই হিসাব রাখতেন রুনাই। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক’র্মক’র্তাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন মহলের ঊর্ধ্বতন ক’র্মক’র্তাদের ‘ম্যানেজ’ ক’রতে রুনাইয়ের দক্ষ’তা অ’পরিসীম। তিনি বিভিন্ন পর্যায়ের ক’র্মক’র্তাদের ‘ম্যানেজ’ ক’রতে সিদ্ধহস্ত।

দুদকের অনুসন্ধান দলের একজন ক’র্মক’র্তা বলেন, পি কের দখলে থাকা ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটিজে’র ১০০ কোটি টাকা নিজে’র মতো করে খরচ করার সুযোগ পান রুনাই। এ ছাড়া পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানিতে (বিআইএফসি) রুনাইয়ের দাপট ছিল।

দুদকের মা’মলায় আ’দালতে দায় স্বী’কার করে ১৬৪ ধারায় জবানব’ন্দি দেন পি কের অন্যতম সহযোগী পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমা’র নন্দী। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর হাকিম আতিকুল ইস’লামের কাছে দেওয়া ওই জবানব’ন্দিতে নাহিদা রুনাই ও অবন্তিকা বড়ালের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন উজ্জ্বল কুমা’র নন্দী। জবানব’ন্দিতে রুনাইকে ‘বড় আপা’ উল্লেখ করে উজ্জ্বল বলেন, ‘পি কে হালদারের দুই বান্ধবী অবন্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাই। এই দুজনের স’ঙ্গে তিনি পৃথকভাবে ২০ থেকে ২৫ বার সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ভ্রমণ ক’রেছেন। পি কে হালদারের সঙ্গ পাওয়া নিয়ে ওই দুজনের মধ্যে চলত ব্যা’পক প্রতিযোগিতা। ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে রুনাই ও অবন্তিকার স’ঙ্গে পি কে হালদারকে আ’লাদাভাবে সময় কা’টাতে দেখা যায়।’

জবানব’ন্দিতে উজ্জ্বল কুমা’র নন্দী আরও বলেন, ‘আম’রা রুনাইকে বড় আপা আর অবন্তিকাকে ছোট আপা ডাকতাম। কারণ রুনাই চালাত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং আর অবন্তিকা চালাত পিপলস লিজিং। পি কে হালদার বিভিন্ন সময় আমাকে বিভিন্ন দেশে প্রমোদ ভ্রমণে পাঠাতেন। তার স’ঙ্গে তিনবার মালয়েশিয়ায় গিয়েছি। আমা’র স’ঙ্গে অমিতাভ অধিকারী, রাজীব সোমও মালয়েশিয়ায় যান। একবার যাই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। প্রতিবারই ভ্রমণের সব খরচ দিয়েছেন পি কে হালদার। তার টাকায় আমি সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে গিয়েছি তিনবার। এসব ভ্রমণে আমা’র সঙ্গী হতো রাজীব সোম, অমিতাভ অধিকারী এবং পি কের বান্ধবী অবন্তিকা বড়াল।’

সিমটেক্সের সিদ্দিকুর রহমান, জেডএ অ্যাপারেলসের জাহাঙ্গীর আলম এবং মা’র্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক শহীদ রেজা পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ ব’ন্ধু উল্লেখ করে উজ্জ্বল জবানব’ন্দিতে বলেন, ‘এদের বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে উপকৃত হয়েছেন পি কে হালদার। দুই ডজন অস্তিত্বহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠান বানিয়ে আত্মীয়স্বজন ও সহযোগীদের ব্যবহার করে পি কে হালদার পিপলস লিজিং, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্স থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে বিদেশে পা’চার ক’রেছেন।’

দুদকের অনুসন্ধান দলের এক ক’র্মক’র্তা আলাপকালে বলেন, ‘রুনাই ও অবন্তিকার স’ঙ্গে পি কে হালদারের স’ম্পর্ক ছিল স্বামী-স্ত্রী’র মতোই। আর রুনাই ও অবন্তিকার স’ম্পর্ক ছিল সতীনের মতো। বিদেশ ভ্রমণ নিয়েও তাদের দুজনের মধ্যে ছিল তীব্র প্রতিযোগিতা। একবার গো’পনে অবন্তিকাকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে প্রমোদ ভ্রমণে যান পি কে। রুনাই বিষয়টি জানতে পেরে পি কের ওপর শা’রীরিক নি’র্যাতন চালান বলে বিভিন্ন জনের বক্তব্যে উঠে এসেছে। এ ছাড়া অবন্তিকার স’ঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নিয়ে পি কের ওপর কয়েক বারই হা’মলা করে রুনাই।’

অবন্তিকাকে নিয়ে গো’পনে বিদেশ যাওয়াকে কে’ন্দ্র করে একবার এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের গুলশানের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে পি কের স’ঙ্গে রুনাই তুমুল ঝগড়া করেন জা’নিয়ে ওই দুদক ক’র্মক’র্তা বলেন, ‘যা উপস্থিত সহক’র্মী রা প্রত্যক্ষ করেন। এ ছাড়া রাতে পি কের বাসায় গিয়ে ব্যা’পক ভাঙচুর করেন রুনাই। অন্য একবার অবন্তিকাকে নিয়ে গো’পনে বিদেশ যাওয়ার সময় হযরত শাহ’জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফিল্মি স্টাইলে দুজনকে ধ’রে নিয়ে আসেন রুনাই। ওই যাত্রায় অবন্তিকাকে নিয়ে প্রমোদ ভ্রমণে যাওয়া হয়নি পি কের।’

গত ১৩ জানুয়ারি অ’বৈ’ধ সম্পদ অর্জনের মা’মলায় অবন্তিকা বড়ালকে গ্রে’প্তার করে দুদক। তাকে দুই দ’ফায় রি’মান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এখন তিনি কা’রাগারে রয়েছেন।দুদক সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার গত সোমবার এক ব্রিফিংয়ে জা’নান, ৮ মা’র্চ নাহিদা রুনাইসহ পি কের ৪৪ সহযোগীর বিদেশ যাত্রায় নি’ষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রুনাইসহ ৩৩ জনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিবরণী জা’রির নোটিস দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে কমি’শন। এ ছাড়া ৩৩ জনের বি’রুদ্ধে ১০টি মা’মলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যার প্রতিটি মা’মলার প্রধান আ’সামি হচ্ছেন পি কে। আগামী রবিবার দুদকের সমন্বিত জে’লা কার্যালয়ে মা’মলাগুলো হওয়ার কথা রয়েছে। সূত্র: দেশ রূপান্তর।