এক বছর আগে নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম ‘হারমনি’র কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছিল চীনের প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে। এ বছরের ডেভেলপার সম্মেলনে সেটির নতুন সংস্করণ আনার পাশাপাশি প্রথমবারের মতো স্মার্টফোনে দেওয়ার ঘোষণাও করেছে হুয়াওয়ে। তাহলে কি সত্যিই স্মার্টফোনের জগতে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে? হুয়াওয়েই বা কিভাবে নিজেদের এর জন্য প্রস্তুত করছে? বিস্তারিত এস এম তাহমিদের কাছে
হুয়াওয়ে তাদের নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে কাজ করছে ২০১৯ সাল থেকে। ওএসটির নাম ‘হারমনি ওএস’। পরিকল্পনা ছিল সেটি স্বল্পশক্তির স্মার্ট ডিভাইস, যেমন রাউটার বা টিভিতে ব্যবহৃত হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হারমনি ওএস ব্যবহার করা হবে শুধু ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ (আইওটি) এবং হোম অটোমেশনের জন্যই—এমনটাই বলেছিল হুয়াওয়ে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে হুয়াওয়েকে এমনভাবে একঘরে করে ফেলেছে যে শেষমেশ তারা আগস্টে ঘোষণা করেই ফেলল—অ্যানড্রয়েডের বদলে ভবিষ্যতের হুয়াওয়ে ফোনে থাকবে ‘হারমনি ওএস’। এটির নাম ভবিষ্যতে বদলে করা হবে ‘হুয়াওয়ে ওএস’।
অ্যানড্রয়েডের মতোই হারমনি ওএস ব্যবহার করবে লিনাক্স কার্নেল। তবে দুটি সিস্টেমের মধ্যে মিল এখানেই শেষ। হারমনি ওএস ব্যবহার করবে মাইক্রোকার্নেল সিস্টেম। পূর্ণ আকৃতির কার্নেল ব্যবহার না করার ফলে হারমনি ওএস হবে অ্যানড্রয়েডের চেয়ে অনেক হালকা, সেটি চালাতে শক্তিশালী প্রসেসর বা অনেক বেশি পরিমাণ র্যামেরও প্রয়োজন হবে না। মাইক্রোকার্নেল ব্যবহারের ফলে একই অপারেটিং সিস্টেম বিভিন্ন ধরনের সিস্টেমে চালানো যাবে কোনো সমস্যা ছাড়াই, যেখানে অ্যানড্রয়েড বা অন্যান্য লিনাক্স সিস্টেমকে নতুন ধরনের ডিভাইসে চালাতে একদম গোড়া থেকে নতুন করে ডিজাইন করতে হয়। হুয়াওয়ের দাবি, তাদের সিস্টেমে তুলনামূলকভাবে অপ্রয়োজনীয় কোড না থাকায় একই ডিভাইসে অ্যানড্রয়েডের চেয়ে অন্তত দ্বিগুণ বেশি পারফরম্যান্স দেখাবে হারমনি ওএস।
অ্যাপ নিয়েও চিন্তা করার প্রয়োজন নেই—দাবি হুয়াওয়ের। নতুন অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করা যতটা কঠিন, তার চেয়েও কঠিন অ্যাপ নির্মাতাদের নতুন সিস্টেমের জন্য অ্যাপ তৈরিতে উৎসাহিত করা। মাত্র কয়েক বছর আগেই দেখা গেছে, শুধু অ্যাপ নির্মাতাদের অনীহার কারণে উইন্ডোজ ফোনের মতো নির্ভরযোগ্য অপারেটিং সিস্টেম ধুলায় মিশে গেছে।
সে সমস্যা কাটাতে হুয়াওয়ে দুটি উপায় বেছে নিয়েছে। প্রথমত, হুয়াওয়ে বিনা মূল্যে অ্যাপ নির্মাতাদের তাদের অ্যাপস্টোরের জন্য অ্যাপ তৈরির প্রশিক্ষণ দেবে। শুধু তাই নয়, অ্যাপ থেকে নির্মাতার যে আয় হবে সেটায় হুওয়াওয়ে আপাতত কোনো ভাগ বসাবে না। দ্বিতীয়ত, হুয়াওয়ের জন্য নির্মাতাদের অ্যাপ একদম গোড়া থেকে তৈরি করতে হবে না। তাদের তৈরি আর্ক কম্পাইলারের মাধ্যমে অ্যানড্রয়েড অ্যাপকে কোনো বাড়তি ঝামেলা ছাড়াই হারমনি ওএসের জন্য প্রস্তুত করা যাবে।
তবে স্মার্টফোন আর ট্যাবলেটেই সীমাবদ্ধ থাকতে তৈরি করা হয়নি হারমনি ওএস। এটা শুরু থেকেই তারা বলে আসছে। হুয়াওয়ে জানিয়েছে, ৫জি নেটওয়ার্কের ফলে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি ডিভাইসই সর্বদা ইন্টারনেটের সঙ্গে থাকবে সংযুক্ত। ফলে একটি ডিভাইসের সঙ্গে আরেকটি ডিভাইসের প্রয়োজন হবে না পেয়ারিং করা বা বারবার আলাদা করে সংযোগ করা। ব্যবহারকারীর চারপাশের প্রতিটি ডিভাইসই থাকবে একে অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত। প্রতিটি ডিভাইসেই যদি চলে হারমনি ওএস, তাহলে কাজও সেগুলো ভাগ করে নিতে পারবে। যেমন ফোনে যদি ব্যবহারকারী একটি সিনেমা দেখার জন্য সার্চ করে, নিজ থেকেই হারমনি ওএস সেটি তার সামনে থাকা টিভিতে দেখাতে শুরু করবে। হারমনিচালিত স্পিকারে চলে যাবে সিনেমার সাউন্ড, ঘরের স্মার্ট বাল্ব স্তিমিত হয়ে আসবে ভালোভাবে সিনেমা উপভোগ করার জন্য।
পরদিন সকালে কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে সিনেমার মাঝখানেই টিভিতে ভেসে উঠবে সেটির তথ্য, স্মার্ট স্পিকারে পরদিনের জন্য সেট হয়ে যাবে অ্যালার্ম। ব্যবহারকারীর হাতের স্মার্ট ঘড়ি খেয়াল রাখবে তার ঘুম স্বাভাবিকভাবেই কখন পাতলা হয়ে আসবে, যাতে স্মার্ট স্পিকারের অ্যালার্ম ঠিক তখন বেজে উঠতে পারে। হারমনির ব্যবহারযোগ্যতাই হবে একাধিক ডিভাইসের মাধ্যমে, তেমনটাই জানিয়েছে হুয়াওয়ে। তবে এত কিছু করা এক দিনে সম্ভব নয়। বর্তমানে শুধু ‘অনার ভিশন’ এবং ‘অনার ভিশন প্রো’ টিভি ছাড়া এখনো হারমনি ওএস চালিত কোনো ডিভাইসের দেখা মেলেনি। স্মার্ট ওয়াচে হুয়াওয়ে এখনো ব্যবহার করছে তাদেরই তৈরি অন্য একটি ওএস, ফোনে চলছে এখনো অ্যানড্রয়েডেরই একটি সংস্করণ। বাদ পড়েছে শুধু গুগল প্লেস্টোর। হুয়াওয়েও স্বীকার করেছে, হারমনি ওএস এখনো স্মার্টফোনে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত নয়। তবে আগামী বছরের মধ্যে সেটি স্মার্টফোনের জন্য তৈরি হবে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে হারমনি ওএস যেন ১২ গিগাবাইট বা আরো বেশি র্যাম এবং অকটাকোর ডিভাইসেও চালানো যায় সেটা নিশ্চিত করা হবে ২০২১ সালের শেষ নাগাদ।
হুয়াওয়ে অ্যাপ গ্যালারি যদিও এর মধ্যেই চালু হয়ে গেছে; কিন্তু হারমনি ওএসের অ্যাপের জন্য সেটিও এখনো প্রস্তুত নয়। অনেক বাধা পেরিয়ে তবেই হারমনি ওএস স্মার্টফোনে হাজির হবে।
শুধু হুয়াওয়েই নয়, ধারণা করা হচ্ছে চীনের বেশির ভাগ ফোন ও স্মার্ট ডিভাইস নির্মাতাই হুয়াওয়েকে হারমনি ওএস তৈরিতে সমর্থন দিচ্ছে। অপো, ভিভো ও শাওমির মতো কম্পানিও গোপনে হুয়াওয়ের হারমনি ওএস নিয়ে পরীক্ষা করে যাচ্ছে বলে গুঞ্জন উঠেছে। চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারে ডিভাইসগুলো হয়তো ২০২১ সালের শেষ বা ২০২২ সালের শুরু থেকে বিক্রি হবে।
হারমনি ওএসের মতো জটিল প্রজেক্ট নিয়ে হুয়াওয়ে হঠাৎ করেই কাজ শুরু করেনি। তাদের দাবি, সাত বছর ধরেই তারা হারমনি ওএস নিয়ে কাজ করে আসছে। চীনা সরকার চায় ২০২২ সালের মধ্যেই পশ্চিমা প্রযুক্তির ওপর নিজেদের নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে, তারই একটি অংশ হবে এই ‘হারমনি ওএস’। তবে যুক্তরাষ্ট্র হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ফলে তারা কাজের গতি বাড়াতে বাধ্য হয়। সেই চাপ না থাকলে হয়তো তারা আরো কয়েক বছর পর হারমনিকে ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় নিয়ে আসত।
হুয়াওয়ের ওপর অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের চাপ শুধু সফটওয়্যারেই নয়। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কম্পানিই হুয়াওয়ের সঙ্গে ব্যবসা করতে চাইলেও পারবে না। সে বিষয়ে স্পষ্ট করেই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে। সঙ্গে এও বলা আছে, যেসব প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের সঙ্গে কাজ করবে তারাও যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কম্পানির সঙ্গে কাজ করতে পারবে না। যার ফলাফল, স্যামসাং বা এলজি হুয়াওয়েকে দেবে না কোনো ডিসপ্লে প্যানেল। গুগল বা মাইক্রোসফট দিতে পারবে না সফটওয়্যার বা সফটওয়্যার সেবা। তার চেয়েও বড় ব্যাপার, এআরএম লিমিটেড হুয়াওয়েকে প্রসেসরের ডিজাইনও দিতে পারবে না। হুয়াওয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে এআরএমের করা ডিজাইন কাজে লাগিয়ে নিজস্ব কিরিন প্রসেসর তৈরি করে আসছিল। সেটাও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা স্মার্টফোন তৈরিই করতে পারবে কি না তা নিয়ে তৈরি হয়েছে সন্দেহ। কোয়ালকম বা মিডিয়াটেকও হুয়াওয়েকে প্রসেসর দেবে না। কেননা তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তারা কাজ করতে পারবে না।
শুধু স্মার্টফোন ও ডিভাইসই নয়, হুয়াওয়ে মাত্রই শুরু করেছিল ল্যাপটপ তৈরি। তাদের মেটবুক সিরিজটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। অ্যাপল ম্যাকবুকের মতো তৈরি পাতলা ও দৃষ্টিনন্দন কম্পিউটারগুলো নিয়েও তারা আর কাজ করতে আপাতত পারবে না। তবে সম্ভাবনা আছে, হারমনি ওএস-ভিত্তিক ল্যাপটপ তারা বাজারে নিয়ে আসবে। অন্তত তাদের ‘সব ডিভাইসে এক ওএস’ স্লোগান সেটারই ধারণা দেয়। সে ক্ষেত্রে প্রসেসর কী হবে বা হারমনির জন্য অফিস স্যুট, মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যার কারা তৈরি করবে সেটাও চিন্তার বিষয়।
হারমনি ওএসের ধারণাটা বাকি সবার চেয়ে আলাদা। মাইক্রোকার্নেলের ওপর তৈরি ওএস, যা সব ডিভাইসেই চালানো যাবে, এমন চিন্তা এর আগে বেশ কিছু কম্পানিও করেছে। তার মধ্যে বলা যায় সবচেয়ে নামকরা গুগলের ‘ফুশিয়া ওএস’। যদিও শুরুতে বেশ কয়েকবার আওয়াজ দেওয়ার পর প্রজেক্টটি স্থগিত হয়ে যায়, হারমনির সঙ্গে বলা যায় গুগলের এই সিস্টেমের মিল সবচেয়ে বেশি। ফুশিয়ারই কথা ছিল একটি সিস্টেম সব ডিভাইসে চলার প্রত্যয় নিয়ে প্রকাশিত হওয়ার। হতে পারে সামনের দিনগুলোতে গুগলও অ্যানড্রয়েড ও ক্রোমওএসের বদলে ফুশিয়া ওএস নিয়েই কাজ করবে। এখন দেখার বিষয় হারমনি ওএস দুনিয়াকে নতুন কী চমক দেয়।