১৬ জেলায় বন্যার অবনতি

বন্যার পানিতে একে একে তলিয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, গ্রাম ও সড়ক। নিম্নাঞ্চল ছেড়ে পানি উঠে পড়েছে সমতলে। একই সঙ্গে বাড়ছে নদীভাঙন। দিশাহারা বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ। অনেক উপজেলা সদরেও ঢুকে পড়েছে বানের পানি। ঝুঁকিতে আছে ঢাকাও।

দেশের ১৬ জেলায় গতকাল শনিবার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় এসব জেলায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। জেলাগুলো হচ্ছে মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, ঢাকা, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নাটোর, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও নওগাঁ। তবে সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নিম্নাঞ্চলে পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে।

গতকাল বন্যা পূর্বাভাস সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা এবং সংশ্লিষ্ট নদ-নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। একই সময়কালে গঙ্গা-পদ্মার পানি সমতলও বৃদ্ধি পেতে পারে। ঢাকা জেলার আশপাশের নদীগুলোতেও সমানুপাতে পানি বাড়ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। তবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত থাকতে পারে।

গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণাধীন ১০১ সমতল স্টেশনের ৪৩টিতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে, আর ৫৮টিতে কমেছে। বিপৎসীমার ওপরে নদীর সংখ্যা ১৭ এবং বিপৎসীমার ওপরে স্টেশনের সংখ্যা ২৭।

রংপুরের গঙ্গাচড়ার চরাঞ্চলে বন্যার পাশাপাশি শুরু হয়েছে নদীভাঙন। প্রায় ৩৫০টি পরিবারের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। অব্যাহত ভাঙনে লোকজন বাড়ি ছেড়ে গরু-ছাগলসহ রাস্তায় অবস্থান করছে। লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের চরশংকরদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পূর্ণ ও চিলাখাল চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। শংকরদহ আবাসন প্রকল্পের প্রায় ৩০০ পরিবারের ঘরবাড়ি, কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা ও চিলাখালের ১৫টি বাড়ি বিলীন হয়েছে। হুমকিতে পড়েছে শংকরদহ হাফেজিয়া মাদরাসা, পাইকান আকবরিয়া মাদরাসা, সাউদপাড়া মাদরাসা, পোস্ট অফিসসহ কয়েকটি গ্রাম ও ফসলি জমি।

দফায় দফায় বর্ষণ ও উজানের ঢলে পানি বাড়ছে গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও করতোয়াসহ অন্যান্য নদ-নদীতে। সদর, সুদরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ২৯ ইউনিয়নের অন্তত এক লাখ ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে গোবিন্দগঞ্জ পৌর এলাকাসহ ছয়টি ইউনিয়নে পানি উঠেছে।

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শিমলা এলাকায় যমুনা নদীতে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। দুই শতাধিক ঘরবাড়ি, মসজিদ ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে আশপাশের আরো কয়েকটি গ্রাম।

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি পাঁচ সেন্টিমিটার বেড়ে ৮৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। কাজীপুর, সদর, উল্লাপাড়া, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলার প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি।

গত শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যমুনার ভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছে সদর উপজেলার ছোনগাছা ইউনিয়নের পাঁচ ঠাকুরী এলাকার দুই শতাধিক পরিবার। নতুন করে ভাঙনের আশঙ্কায় ঘরবাড়ি ভেঙে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ব্যস্ত রয়েছে আরো শতাধিক পরিবার।

কুড়িগ্রামের উলিপুরে তৃতীয় দফা বন্যাকবলিত এলাকার গ্রামীণ সড়কগুলো তলিয়ে থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। দেড় লক্ষাধিক পানিবন্দি মানুষ দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে।

জামালপুরে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রসহ জেলার সব নদী-নদীর পানি ফের বাড়ছে। যমুনা গতকাল সন্ধ্যায় বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হয়। ফলে দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলাসহ জেলার সাত উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির ফের অবনতি হচ্ছে। প্রায় দশ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। ইসলামপুরের গোয়ালের চর-সভার চর রাস্তায় ছোট একটি সেতু ভেঙে গেছে।

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার উচাখিলা ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্র নদের কোলঘেঁষা মরিচার চর গ্রামের পাকা সড়কটির ৫০ মিটার গতকাল নদীগর্ভে চলে গেছে।

মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার টেকেরহাট থেকে শ্রীনদী যাতায়াতের সড়কটি শাখারপাড় এলাকায় প্রায় ৩০০ মিটার কুমার নদে বিলীন হয়েছে। ইশিবপুর ইউনিয়নের মল্লিককান্দি ও গাংকান্দি শাখারপাড়ের মাঝামাঝি এলাকার বেশ কিছু বাড়ি ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্বম্বরদী গ্রামের রাস্তাসহ ফসলি জমি নদের ভাঙনে পড়েছে।

অতিবৃষ্টি ও জোয়ারের তোড়ে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় মিরুখালী-ভগীরথপুর পাকা সড়ক ধসে গেছে। এতে মিরুখালী ইউনিয়ন বাজারের সঙ্গে ভগীরথপুর হয়ে ভাণ্ডারিয়া-চরখালী সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পদ্মার পানি বেড়ে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পদ্মা এখানে বিপৎসীমার ১১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। তলিয়ে গেছে দৌলতদিয়া ৩ নম্বর ফেরিঘাটের সংযোগ সড়ক। ফরিদপুরের সাত উপজেলার ৫৪১টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি দেড় লক্ষাধিক মানুষ। মধুমতী নদীতে পানি বেড়ে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার কালনা ফেরিঘাটের উভয় পাশের পন্টুনের গ্যাংওয়ে তলিয়ে গেছে।

উজানের ঢল আর ভারি বর্ষণে ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বৃদ্ধির ফলে শেরপুরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, দশানি, মৃগীসহ জেলার বিভিন্ন নদ-নদীতে পানি বাড়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনা ও চর অষ্টধর ইউনিয়নের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। অন্তত এক লাখ লোক পানিবন্দি। শেরপুর-জামালপুর মহাসড়কে নন্দির বাজার অংশ ডুবে যাওয়ায় যোগায়োগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে মানুষের বাড়ি থেকে ধীরে ধীরে পানি নামতে শুরু করলেও নদ-নদী ও হাওরে পানি বাড়ছে। উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের প্রায় সব সড়কে স্থানে স্থানে বন্যার পানি রয়েছে। তলিয়ে আছে গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট।

তুরাগ নদের সেতুর সংযোগ সড়কে ধস, যান চলাচল বন্ধ : গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বড়ইবাড়ী এলাকায় তুরাগ নদে সেতুর সংযোগ সড়কের মাঝখানে ধসে যাওয়ায় গতকাল সকাল থেকে সফিপুর-ফুলবাড়িয়া সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে শিল্পাঞ্চল সফিপুরসহ উপজেলা সদরের সঙ্গে প্রায় ৩০টি গ্রামের লোকজনের চলাচল বন্ধ রয়েছে। খবর পেয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ধসে যাওয়া স্থান পরিদর্শন করেন।

ত্রাণের সংকট নেই—প্রতিমন্ত্রী : গতকাল সচিবালয় থেকে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, ‘গত ২৬ জুন বন্যা শুরু হয়, ১১ জুলাই থেকে দ্বিতীয় দফায় পানি বাড়ে এবং ২১ জুলাই থেকে তৃতীয় দফায় পানি বাড়ছে। বন্যায় ত্রাণ সহায়তা তদারকি করতে ছয়টি কমিটি করা হয়েছে। কোথাও ত্রাণের কোনো সংকট নেই।’