আমাদের ভাষা শিক্ষক সরোজ মেহেদী স্যারের কাছে যখন শুনলাম আমাদের আধুনিক ভাষা ইন্সটিউটের (আ,ভা,ই) তুর্কী ভাষা জুনিয়র কোর্স থেকে এবছর আমরা শিক্ষা সফরে যাবো, তখন যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির দেখা পেলাম।
আমাদের ক্লাসে বিভিন্ন বয়স ও পেশার শিক্ষার্থী থাকায় সবার জন্য দিন-ক্ষণ গুনে অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহের শুক্র ও শনিবারকেই বেছে নেয়া হলো।
২৫শে অক্টোবর ২০১৯। শুক্রবার। নাস্তা সেরে যখন বের হলাম, তখন ঘড়ির কাঁটা ১০টা ছুঁই ছুঁই করছে। সিলেটের সাদা পাথরের উদ্দেশ্যে সিলেট অঞ্চলে যে পর্যটনগুলো স্থানগুলো ইতিমধ্যে দর্শকপ্রিয়তা কুড়িয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিছানাকান্দি, জাফলং, তামাবিল, লালাখাল, সাদা পাথর এবং রাতারগুল নামক এক বিস্তীর্ণ জলাবন।
সিলেটের বিভিন্ন পর্যটন স্থান ভ্রমণ করে এলেও এই সাদাপাথর স্থানটি সবার কাছে অজানাই রয়ে গিয়েছিলো। তাই আমরা পরিকল্পনা করলাম, প্রথম দিন সাদা পাথর আর সিলেট শহর ভ্রমণ শেষে পরের দিন চলে যাবো মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে।
আমাদের গাড়িতে করে দারুন ফুরফুরে মেজাজে রওনা দিলাম সাদা পাথরের উদ্দেশ্যে। সিলেট শহর থেকে এয়ারপোর্টের রাস্তা ধরে কোম্পানীগঞ্জ মহাসড়কে উঠলাম। চারপাশের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে আর গান গাইতে গাইতে কখন যে পৌঁছে গিয়েছি সাদা পাথর!
সে এক অপূর্ব দৃশ্য! সামনে আর ডানে পাহাড়ের রাশি। সবুজ পাহাড়ের উপরে দৃশ্যমান নীলচে পাহাড়। আর সাদা মেঘের ভেলা অনেকখানি দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যেনো নীলচে পাহাড়ের চূড়োগুলোকে ঢেকে রেখেছে।
মনে হচ্ছিলো, পাহাড় বেয়ে উঠতে পারলে হয়তো মেঘগুলোকে ছোঁয়া যাবে! কিন্তু সাদা পাথর কই?
সাদা পাথর যাবো বলতেই মাঝি জানালেন, যাওয়া-আসা মিলিয়ে নৌকার ভাড়া মোট ৮০০ টাকা। একটি খালি নৌকা ঠিক করে দলবল নিয়ে উঠে পড়লাম।
আঁকা-বাকা ছোট্ট ধলাই নদী দিয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের নৌকা। আশপাশে আরও অনেক নৌকাই যাচ্ছে আর ফিরে আসছে। কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে দূরের পাহাড় আর মেঘের রাজ্য যেনো আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগলো। মনে হলো, দূরের পাহাড়গুলো এই তো, আর একটু গেলেই হয়তো ছোঁয়া যাবে।
প্রায় ১০ মিনিটের মাথায় নদীর ওপারে পৌছলাম। নৌকার মাঝি তার মোবাইল নাম্বার আমাদের দিয়ে বললো, আমাদের ঘোরাঘুরি শেষে তাকে কল দিলে আবার এসে আগের জায়গায় নিয়ে যাবে।
নৌকা থেকে নেমেই দেখলাম, বালুচর। বালু রাশির মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিনিট দুইয়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ছোট ছোট পাথরের সমুদ্রে।
কোথাওবা পাথরের উপর দিয়েই বয়ে চলেছে অল্প গভীর ধলাই নদী। পানিতে নেমে নিচের পাথরগুলোর উপর দাঁড়াতেই অজানা শিহরণ খেলে গেলো সারা
শরীরে। পানির মধ্য দিয়ে যতোদূরই হেঁটে যাচ্ছি, শুধু পাথর আর পাথর। পানির নিচে ছোট পাথরগুলো পিচ্ছিল হওয়ায় একটু সতর্কতার সাথেই জলধারার মধ্য দিয়ে হাঁটতে হচ্ছিলো।
এবার আমাদের গন্তব্যস্থল মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা, যা চায়ের রাজধানী নামে খ্যাত। বর্তমানে দেশের ১৬৩টি চা-বাগানের মধ্যে ৪০টিরই অবস্থান এই শ্রীমঙ্গল উপজেলায়।
শ্রীমঙ্গল চা জাদুঘরে চলে এলাম। শ্রীমঙ্গলের রানমগরে অবস্থিত বিখ্যাত আদি নীলকন্ঠ চা ক্যাবিনে। এখানে এক-রঙা থেকে শুরু করে আট-রঙা পর্যন্ত চা পাওয়া যায়। এক-রঙা চায়ের মূল্য ১০ টাকা। আর প্রতি অতিরিক্ত রঙ বা স্তরের জন্য ১০ টাকা করে বেশি দিতে হয়। অর্থাৎ আট-রঙা চায়ের মূল্য ৮০ টাকা। চায়ের প্রতিটি স্তরের স্বাদ যেমন আলাদা, তেমনি সুস্বাদু। এই চায়ের দোকানকে ঘিরে এখানে ছেলেদের কাপড়, মনিপুরী কাপড়-ব্যাগ, আচার, ফুচকা এবং চা-পাতার দোকান নিয়ে একটি ছোট বাজার গড়ে উঠেছে। শ্রীমঙ্গল চায়ের পাশাপাশি আনারস উৎপাদনের জন্যও বিখ্যাত।
এবার ফেরার পালা। ইতিমধ্যে অবশ্য সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। শ্রীমঙ্গল থেকে বের হওয়ার সময় নান্দনিক “চা-কন্যা” নামক ভাস্কর্যটি চোখে পড়লো। দু’দিনের এই শিক্ষা সফরের নিরাপদে ঢাকায় পৌঁছালাম।