আওয়ামী লীগ প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না- এমন মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এতিমের টাকা আত্মসাৎ করে আদালতের রায়ে খালেদা জিয়া কারাগারে রয়েছেন। কারাগারে তিনি রাজার হালেই রয়েছেন। পৃথিবীর কোনো ইতিহাস নেই যে, আদালত কর্তৃক কোনো সাজাপ্রাপ্ত আসামির সেবা করার জন্য একজন কাজের বুয়া দেয়া হয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার জন্য, তার সেবার জন্য একজন কাজের বুয়াও কারাভোগ করছেন। আমরা তা দিয়েছি, কারণ আমাদের কোনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নেই।
বুধবার বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে প্রায় তিন বছর পর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় কমিটির বৈঠকে সূচনাবক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বৈঠকে বিগত তিন বছরের দলের বাজেট ও জাতীয় কাউন্সিলের বাজেট উপস্থাপন এবং তা সর্বসম্মতিতে পাস করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় কমিটির এই সভায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সভা পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
প্রতিবছর জাতীয় কমিটির সভা করার কথা থাকলেও আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে প্রায় তিন বছর পর এই সভাটি অনুষ্ঠিত হল। সভায় আওয়ামী লীগের আয়-ব্যয়ের হিসাব অনুমোদন ছাড়াও আসন্ন কেন্দ্রীয় ত্রিবার্ষিক জাতীয় সম্মেলনের সম্ভাব্য বাজেটেরও অনুমোদন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নতুন নয়, অনেক পুরনো। ক্ষমতায় থাকতে ১৯৯১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খালেদা জিয়ার ‘নি রিপ্লেস’ (হাঁটু প্রতিস্থাপন) করা হয়। পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় থাকতে সৌদি আরবেও তার দেহে একাধিকবার অস্ত্রোপচার করা হয়। ওই সময় তিনি ওমরা ও মার্কেট করতে হুইলচেয়ারে করে চলতেন, আর ওই হুইলচেয়ার ফালু (মোসাদ্দেক আলী ফালু) ঠেলে নিয়ে যেতেন, তা সবাই দেখেছে। কাজেই এখন তার হুইলচেয়ারে চলাফেরা নতুন কিছু নয়।
তিনি বলেন, আর যেন কোনো সুদখোর, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, জঙ্গিবাদী, অগ্নিসন্ত্রাসী, মানুষকে পুড়িয়ে হত্যাকারী ও এতিমের টাকা আত্মসাৎকারীরা ক্ষমতায় আসতে না পারে- সেদিকে দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
বিএনপি-জামায়াত জোটের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান, তার স্ত্রী খালেদা জিয়া ও পুত্র তারেক রহমানসহ পুরো পরিবারই খুনি পরিবার। আর খালেদা জিয়া হচ্ছেন সন্ত্রাসের ‘গডমাদার’। যিনি ঠাণ্ডামাথায় হরতাল-অবরোধের নামে শত শত জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করতে পারেন, এর থেকে বড় সন্ত্রাস আর কী হতে পারে? তার (খালেদা জিয়া) মতো বড় সন্ত্রাসী আর কে হতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঠাণ্ডামাথায় হরতাল-অবরোধ দিয়ে খালেদা জিয়া জীবন্ত শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করিয়েছেন। সেই অবরোধ-হরতাল এখনও তোলেননি। তার হুকুমে কত মায়ের কোল খালি হয়েছে, কত বোন বিধবা হয়েছে এবং কত পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। সে (খালেদা জিয়া) তো জেলে আছেন, বেশ ভালো আছেন। কিন্তু তার জন্য কারও কারও মায়াকান্নাও দেখি। কিন্তু তার জন্য মায়াকান্নার আগে অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হওয়া পরিবারগুলোর দিকে একবার সবার তাকিয়ে দেখা উচিত। বিএনপি-জামায়াতের ভয়াল অগ্নিসন্ত্রাস, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, নাশকতা, প্রায় ৫শ’ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার কথা মানুষ এত তাড়াতাড়ি ভুলে যায় কীভাবে?
সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকে এই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছে? নির্বাচনের আগে বিএনপি আন্তর্জাতিক সব জরিপ ও দেশের জনগণের মনের কথা আগেই বুঝতে পেরেছে যে, নির্বাচনে তাদের জয়ের কোনো সম্ভাবনাই নেই। কারণ দেশের জনগণ তাদের দুঃশাসন ও মানুষ হত্যার কথা ভোলেনি।
তিনি আরও বলেন, তাই বিএনপি জেতার জন্য নির্বাচন করেনি, নির্বাচনকে অর্থ বানানোর বাণিজ্য হিসেবে নিয়েছিল। তারা একেকটি আসনে ৩/৪ জন করে মনোনয়ন দিয়েছিল। কখনও লন্ডনে থাকা একজনকে খুশি করে, আবার পল্টনে থাকা নেতাদের খুশি করে কেউ মনোনয়ন পেয়েছেন, আবার কেউ অনেক বেশি অর্থ দিলেই তা পরিবর্তন করা হয়েছে। যে যত বেশি অর্থ দিতে পেরেছে, সে মনোনয়ন পেয়েছে। একেক আসনে একাধিক প্রার্থী দিয়েছে, কারণ তারা জানেই যে জিততে পারবে না। তাই এই নির্বাচন নিয়ে তাদের মুখে কোনো কথা মানায় না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা আসেনি। যারা জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করে, নাশকতা চালায়, তাদের জনগণ ভোট দেবে কেন? এটা বুঝতে পেরেই তারা নির্বাচনে না এসে গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করতে চেয়েছিল, কারণ তারা জনগণের শক্তি, সমর্থন ও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। কারণ এই দলটির (বিএনপি) জন্ম জনগণের মধ্য থেকে হয়নি, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক স্বৈরাচারের উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে এই দলটির জন্ম। তারা জানত নির্বাচনে গেলে তারা জিতবে না, সেজন্যই জনগণকে তারা পুড়িয়ে হত্যা করেছে।
বাংলাদেশ উন্নয়নে সারা বিশ্বের সামনে বিস্ময় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই দেশের উন্নতি হয়, দেশ সবদিক থেকে এগিয়ে যায়। এটাকে অনেকেই কিছু বলতে পারে। কিন্তু আমার প্রশ্ন- তারা (বিএনপি) অনেককিছু করলে দারিদ্র্যের হার কমেনি কেন? প্রবৃদ্ধির হার বাড়েনি কেন? আর্থসামাজিক উন্নতি হয়নি কেন। একমাত্র আওয়ামী লীগ সরকার যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই দেশের উন্নতি হয়েছে। আজ আমরা ৮ দশমিক ১৩ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। খালেদা জিয়ার রেখে যাওয়া ৪১ ভাগ দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আমরা ২১ ভাগে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি, এই হার আমরা আরও নামিয়ে আনব।
টেলিভিশন খাতকে বেসরকারি খাতে উন্মুক্ত করে দেয়ায় মানুষ কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ যে এত টেলিভিশন চ্যানেল, সেটা কে দিয়েছে? বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করা, সেটা কে করেছে? এগুলো আমাদের সরকার করেছে। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালীন তো করেননি। আমি যখনই প্রধানমন্ত্রী হয়েছি, তখনই বেসরকারি টেলিভিশন উন্মুক্ত করে দিয়েছি। এখানে বিপুলসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর টকশোতে গিয়ে টক-মিষ্টি কথা বলার কথা মানুষ পাচ্ছে। টক টক কথা তো বলেই যাচ্ছে। এই দৃশ্য তো সবাই দেখছে। এত কথা বলতে সুযোগ দেয়ার পরও অনেকে বলেন, আমাদের কথা বলার অধিকার নেই! বলেই যাচ্ছে, তারপরও পরচর্চা করবে। আসলে এই ধরনের পরচর্চা একধরনের অভ্যাস।