বরগুনায় রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় করা মামলার প্রধান সাক্ষী ও তাঁর স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বলেছিলেন, মিন্নি হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত। আদালতে মিন্নির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার আগেই তাঁর নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে খুনের পরিকল্পনায় মিন্নির জড়িত থাকার কথা পুলিশ সুপার বলেছিলেন।
সম্প্রতি আদালতে দেওয়া মিন্নির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশের পর পুলিশ সুপার তাঁর সুর পাল্টে ফেলেছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার আগে তিনি মিডিয়াকে তাঁর (মিন্নি) সম্পৃক্ততার কথা বলেননি। বলেছেন, তদন্তে ঘটনার সঙ্গে মিন্নির জড়িত থাকার বিষয়টি বললেননি বলেছেন প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে।
আদালতে মিন্নির দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বরাত দিয়ে একটি জাতীয় দৈনিক গত সোমবার সংবাদ প্রকাশ করে।
এনিয়ে সাংবাদিকরা বিষয়টি জানার জন্য ওই দিনই পুলিশ সুপারের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে দেখা করেন। পুলিশ সুপারের কাছে সাংবাদিকরা মিন্নির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সম্পর্কে জানতে চান। তিনি তখন সাংবাদিকদের বলেন, তদন্তাধীন মামলার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রকাশের সুযোগ নেই। যদি প্রকাশ পায় তাহলে মামলার তদন্তে সমস্যার সৃষ্টি হবে।
ওই দৈনিক মিন্নির জবানবন্দি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে। তারা কিভাবে তথ্য পেল? সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কপি পুলিশের পাশাপাশি আদালতে রক্ষিত থাকে। পুলিশের কোনো কর্মকর্তা ওই জবানবন্দির কপি কাউকে সরবরাহ করেননি। এমনকি ওই পত্রিকাটি কোথা থেকে জবানবন্দির কপি পেয়েছে তাও তিনি জানেন না।
গোপন জবানবন্দি প্রকাশ্যে
পুলিশের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রিফাত হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত ১৫ আসামি আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মিন্নির রিমান্ড শুনানির সময় আদালতে পুলিশ দুটি বিষয় উপস্থাপন করেছিল। একটি হলো মিন্নির সঙ্গে আসামিদের কথোপকথনের মোবাইল কল লিস্ট। অন্যটি আদালতে দেওয়া আসামি টিকটক হৃদয়ের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি। খুনের পরিকল্পনার সঙ্গে মিন্নি জড়িত বলে টিকটক হূদয় জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছে বলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বরগুনার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন।
মিন্নির জামিন শুনানির দিন আদালত সূত্রে দুই আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মিন্নির সম্পৃক্ততার কথা সংবাদমাধ্যমে এসেছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শুধু দুই আসামির নাম বলেছেন। কিন্তু মিন্নি খুনের সঙ্গে কিভাবে জড়িত তা তিনি সাংবাদিকদের জানাননি।
গত ২৬ জুন রিফাত শরীফকে দিনদুপুরে শত শত লোকের সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই দিন রাতেই ১২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরো চার-পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন তাঁর বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ। মামলায় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে এক নম্বর সাক্ষী করা হয়। এরপর গত ১ জুলাই থেকে গ্রেপ্তারকৃতরা আসামিরা একের পর এক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সেই সব আসামির জবানবন্দি প্রকাশ হয়নি। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী সেই জবানবন্দি প্রকাশ হওয়ার কথাও না। কিন্তু মিন্নিকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের কাছে তাঁর দেওয়া ১৬১ ধারার জবানবন্দি একটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে। এরপর আদালতে ১৬৪ ধরায় মিন্নির দেওয়া জবানবন্দি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। ওই দৈনিকটি কোন সূত্র থেকে জবানবন্দির কপি পেয়েছে, তা উল্লেখ করেনি।
এ ব্যাপারে মিন্নির পরিবার প্রশ্ন তুলেছে। তারা বলছে, যারা প্রকাশ্যে রিফাতকে কোপাল, তারাও জবানবন্দি দিয়েছে। সেটি সংবাদমাধ্যমে না এসে কেন ঘুরেফিরে তাঁদের মেয়ের (মিন্নি) জবানবন্দি প্রকাশ হচ্ছে? কারাই বা এই জবানবন্দি সংবাদমাধ্যমকে সরবরাহ করছে? শুধু তা-ই নয়, নয়নের বাসা থেকে মিন্নির ব্যবহৃত জিনিসপত্র উদ্ধার নিয়ে তাঁর পরিবার প্রশ্ন তুলেছে।
মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, ‘মিন্নিকে গ্রেপ্তারের পর একটি অনলাইন পোর্টালে দেখেছি, মোবাইল ফোন নিয়ে বিরোধের জের ধরে রিফাত খুন হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মোবাইল ফোন নিয়ে রিফাত ও মিন্নির মধ্যে ঘটনার দুই দিন আগে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে আমরা জানতাম। যেটি আমরা জানি না সেটি নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড? গত সোমবার একটি জাতীয় দৈনিকে মিন্নির স্বীকারোক্তি নিয়ে সংবাদ ছেপেছে। তারাও বলেছে, মোবাইল ফোন নিয়েই ঘটনার সূত্রপাত। অবাক হলাম এই ভেবে, যারা রিফাতকে কুপিয়েছে, তারা আদালতে কী বলেছে তা জানতে পেলাম না।’
তিনি আরো বলেন, ‘প্রভাবশালী চক্রটি নির্যাতন করে মিন্নির কাছ থেকে আদায় করা জবানবন্দি প্রকাশ্যে এনেছে। যাতে তারা প্রমাণ করতে পারে যে মিন্নির জন্যই রিফাত খুন হয়েছে। তাতে মামলা দুর্বল হবে। প্রভাবশালীদের ক্যাডাররা খুনের দায় থেকে বেঁচে যাবে।’
মিন্নিকে রিমান্ডে নেওয়ার পরদিন সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার যা বলেছিলেন
মিন্নিকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয় গত ১৭ জুলাই। এর পরদিন মামলার অন্যতম আসামি রিশান ফরাজীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই দিন পুলিশ সুপার তাঁর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। শুরুতেই পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বলেন, ‘এই মামলা নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং দু-একটি মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে। আমি আজকে আপনাদের সব ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিতে যাচ্ছি। যাতে করে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি না থাকে।’
খুনের সঙ্গে জড়িত বলে মিন্নি কি নিজে স্বীকার করেছেন—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, ‘করেছে।’ কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ‘মিন্নি স্বীকার করেছে বলেই আমরা এই বিষয়গুলোর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বিজ্ঞ আদালতের কাছে যৌক্তিকতা তুলে ধরে রিমান্ডের আবেদন করেছি। আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।’
মিন্নি কিভাবে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত—জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, ‘মিন্নি শুরু থেকেই, যারা হত্যাকারী ছিল, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। সে এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার অংশ। এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পূর্বেও সে এ হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে পরিকল্পনার জন্য যা যা দরকার, মিটিং করেছে হত্যাকারীদের সাথে।’
মিন্নির জামিন শুনানি ৩০ জুলাই
আমাদের বরগুনা প্রতিনিধি জানান, গতকাল মঙ্গলবার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মিন্নির জামিন চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। আবেদন গ্রহণ করে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আসাদুজ্জামান নিম্ন আদালতের নথি তলব করে শুনানির জন্য আগামী ৩০ জুলাই দিন ধার্য করেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মিন্নির আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাহবুবুল বারী আসলাম।
এর আগে গত রবিবার মিন্নির জামিন চেয়ে আবেদন করা হলে শুনানি শেষে বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচার বিভাগীয় হাকিম মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম গাজী আবেদন নামঞ্জুর করেন।