পতিতাবৃত্তিতে নামতে বাধ্য হচ্ছেন স্কুল শিক্ষিকারাও!

অর্থনৈতিক সঙ্কটে জর্জরিত ভেনিজুয়েলার নারীরা সীমান্ত পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিচ্ছেন। এর মধ্যে অন্যতম একটি দেশ কলম্বিয়া। আর সেখানে গিয়ে তারা দেশটির বিভিন্ন বারে পতিতাবৃত্তিতে নাম লেখাচ্ছেন। দেশে থাকতে তাদের কেউ ছিলেন স্কুল শিক্ষক, পত্রিকার হকার কিংবা আরও নানা পেশার মানুষ। কিন্তু জীবন বাঁচানোর তাগিদে কর্ম ও অর্থের সন্ধানে তারা নিজ দেশে ছেড়ে ভিনদেশে এমন পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে এমনই একটি প্রতিবেদন তৈরি করে ভারতের একটি গণমাধ্যম।

প্রতিবেদনে বলা হয়, তিন সন্তানের মা প্যাট্রিসিয়ার (৩০) অভিজ্ঞতাটা একটু তিক্ত। কলম্বিয়ার মধ্যাঞ্চলের কালামারে একটি পতিতাপল্লীতে কাজ করছেন তিনি। সেখানে অনেক সময় নেশাগ্রস্ত গ্রাহকের হাতে শারীরিক নিপীড়নেরও শিকার হতে হয় তাকে। তিনি বলেন, ‘পল্লীতে অনেক গ্রাহক আছে, যারা আপনাকে একেবারে খারাপ দৃষ্টিতে দেখবে; যা ভয়ঙ্কর। প্রত্যেকদিন আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, আজকের গ্রাহক যেন ভালো হয়।

অ্যালেজরিয়া। ভেনিজুয়েলায় তিনি ছিলেন ইতিহাস এবং ভূগোলের শিক্ষক। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে ভেনিজুয়েলায় তিনি মাসে আয় করতেন ৩ লাখ ১২ হাজার বলিভার; যা এক ডলারেরও কম। তার এই বেতনে এক প্যাকেট পাস্তাও কেনা যায় না। চার সন্তানের মা ২৬ বছর বয়সী এই নারী গণমাধ্যমকে এসব কথা বলেন।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কলম্বিয়ায় ঢুকে পড়েন। প্রথম তিন মাস তিনি দেশটির একটি হোটেলে ওয়েট্রেস হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু এর বিনিময়ে তিনি কোনো বেতন পেতেন না। সামান্য কিছু টিপস পেতেন।

অ্যালেজরিয়া বলেন, দেশে আমার পরিবারের কাছে এই টিপসের অর্থ পাঠাতাম। তার সন্তান-সহ পরিবারে রয়েছে ছয় সদস্য। কিন্তু এই চাকরিটা হারানোর পর অ্যালেজরিয়া কালামারে পাড়ি জমাতে বাধ্য হন। অন্য আরো নয়জন নারীর সঙ্গে অ্যালেজরিয়া ৩ হাজার মানুষের শহর কালামারের একটি বারে প্রত্যেক রাতে দেহ ব্যবসা করছেন। প্রত্যেক গ্রাহকের কাছ থেকে পান ৩৭ হাজার থেকে ৫০ হাজার পেসো (১১ থেকে ১৬ ডলার)। কিন্তু তার এই আয়ের সাত হাজার পেসো দিতে হয় বারের ম্যানেজারকে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে কোনো রাতে অ্যালেজরিয়ার আয় হয় ৩০ থেকে ১০০ ডলার পর্যন্ত। অ্যালেজরিয়ার স্বপ্ন তিনি কলম্বিয়ায় স্কুল শিক্ষিকা হিসেবে আবারো কাজ শুরু করবেন। কিন্তু পাসপোর্ট ছাড়া এটি সম্ভব নয়।

এদিকে, গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপের সময় গলা ধরে আসছে জলির। তিনিও অ্যালেজরিয়ার মতো নিজ দেশ ছেড়ে কলম্বিয়ায় পৌঁছে দেহ ব্যবসা করে পরিবারের ভরণ-পোষণ চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমরা কখনোই দেহ ব্যবসা করতে চাই না। আমরা এই কাজ করছি সঙ্কটের কারণে।

৩৫ বছর বয়সী এই নারী দেশে থাকতে পত্রিকারের হকার ছিলেন। কিন্তু ২০১৬ সালে দেশটিতে কোনো পত্রিকাই বের হচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে এই পেশা ছেড়ে কলম্বিয়ায় আসেন তিনি। মন্দার চার বছর ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কয়েক বছর পর ভেনিজুয়েলায় এখনো মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে থাকা দেশটির মানুষ খাদ্য সংস্থান, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও পাচ্ছেন না।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্য বলছে, চলতি বছরে দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন শতাংশে পৌঁছেছে। আগামী বছর এই মুদ্রাস্ফীতির হার এক কোটি শতাংশে পৌঁছাতে বলে মুদ্রা তহবিলের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে।

জলির গল্পটা আরো বেদনাদায়ক। এর আগে স্বামী তাকে ডিভোর্স দিয়েছেন। স্বামী ছেড়ে যাওয়ায় সন্তানদের লালন-পালন করছেন তিনি। জলি তার মা ও তিন সন্তানকে দেশে রেখে এসেছেন। দেশে থাকতে একটি চাকরির জন্য এক শহর থেকে অন্য শহর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন তিনি। কিন্তু হতাশ হয়ে পাসপোর্ট ছাড়াই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কলম্বিয়ায় ঢুকে পড়েন তিনি। কলম্বিয়ায় যখন আসেন তখন পরনের কাপড় ছাড়া তার সঙ্গে কিছুই ছিল না।

জাতিসংঘ বলছে, ভেনিজুয়েলায় অর্থনৈতিক সঙ্কট শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৯ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।

জলি বলেন, আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। দেশে ক্লিনারের কাজ জোগার করতেও সক্ষম হননি তিনি। শেষ পর্যন্ত কলম্বিয়ায় যেতে বাধ্য হন; সেখানে পৌঁছে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। চলতি বছরের জুনে কালামারে তার সঙ্গে এই পেশায় নাম লিখিয়েছেন জলির ভাইয়ের ১৯ বছর বয়সী মেয়ে মিলাগরো। এই কিশোরী বলেন, প্রথমে আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি এই কাজ করতে বাধ্য হন। কারণ দেশে তার মা অসুস্থ। মায়ের চিকিৎসার পাশাপাশি ছোট ভাই ও দুই বছর বয়সী সন্তানের ভরণ-পোষণ চালাতে হয় তাকে। পরে তার মা মারা যান।