চার আসন প্রার্থী ‘শূন্য’, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অধিকাংশ আসনে একাধিক ‘বিকল্প’ প্রার্থীকে প্রাথমিক মনোনয়ন দিয়েও ‘শেষ রক্ষা’ হলো না বিএনপির। চার আসনে দলটির সব প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। বগুড়া-৭, ঢাকা-১, মানিকগঞ্জ-২ এবং জামালপুর-৪ আসনে বিএনপির মনোনীত কোনো প্রার্থীরই মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে টেকেনি। তারা আপিলে প্রার্থিতা ফিরে না পেলে এসব আসন বিএনপি প্রার্থী শূন্য থাকবে। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি আসনে প্রার্থীরা নানা জটিলতার মুখে পড়েছিলেন।
এ বিষয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচন কমিশনকে গতকাল রোববার চিঠি দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশন সচিব ও সংশ্নিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তাদের টেলিফোন করে দলীয় মনোনয়ন-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের আশ্বাস দিয়ে প্রার্থিতা রক্ষা করলেও উদ্বিগ্ন দলের হাইকমান্ড। নির্বাচনের আগেই দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একটিসহ চারটি আসনে প্রার্থিতা শূন্যতা নিয়ে দলের ভেতর তৈরি হয়েছে কিছুটা হতাশা। প্রার্থী রক্ষায় বিএনপি ৩০০ আসনে ৬৯৬ জনকে মনোনয়ন দিয়েছিল। দলটির অভিযোগ, বেছে বেছে তাদের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা।
বিএনপির নীতিনির্ধারক কয়েকজন নেতা সমকালকে জানান, বিএনপির আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হলো। নানা অজুহাত দেখিয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ বিপুলসংখ্যক বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়নপ্রাপ্ত নেতাদের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। এ আশঙ্কা থেকে একাধিক বিকল্প প্রার্থী দিয়েও শেষ রক্ষা হলো না। কয়েকটি আসনে প্রার্থী শূন্য হয়ে পড়ল। আবার অনেক আসনে প্রধান যোগ্য প্রার্থী বাতিল হয়ে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত তুলনামূলক দুর্বল নেতা প্রার্থী হিসেবে মাঠে থাকলেন। এতে ভোটযুদ্ধে শক্তিশালী ও জনপ্রিয় প্রার্থীর সংখ্যাও কমে গেল। এ পরিস্থিতিতে তারা কিছুটা চিন্তিত।
বিএনপি সূত্র জানায়, নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের শেষ দিন গতকাল রোববার বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটি দিনভর মনিটর করেছে। একই সঙ্গে লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান টেলিফোনে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখেন। শূন্য আসনগুলোয় স্বতন্ত্র প্রার্থীকে কাকে দলীয় সমর্থন দেওয়া যায়- সে ব্যাপারে সংশ্নিষ্ট যোগ্য ও সমমনা প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি। ইতিমধ্যে ঢাকা-১ প্রার্থী শূন্য আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সাংসদ সালমা ইসলামকে সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে বিএনপি।
সূত্র আরও জানায়, বাছাইয়ে বেশকিছু আসনে দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন ফরম পূরণে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের স্বাক্ষরের অমিলসহ নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি ও জটিলতার খবর পায় বিএনপি নির্বাচন পরিচালনা কমিটি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মির্জা ফখরুল নিজেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা এবং নির্বাচন কমিশনার হেলালুদ্দীন আহমদসহ রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসকদের টেলিফোন করেন। স্বাক্ষর অমিলের বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করে তা গ্রহণ করার অনুরোধ করেন। একই সঙ্গে সংশ্নিষ্ট প্রার্থীদের দ্রুত ঢাকা এসে তার কাছ থেকে আবার স্বাক্ষর ও মনোনয়নের প্রত্যয়নপত্র নেওয়ার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও কমিটির অন্যতম সদস্য দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুসহ অন্য সদস্যরাও টেলিফোন করে দলীয় প্রার্থী ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যার সমাধান করেন।
বগুড়া-৭ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন খালেদা জিয়া। দুর্নীতির দুটি মামলায় তার ১৭ বছর সাজার রায় রয়েছে। তবে দুই বছরের বেশি দণ্ডপ্রাপ্ত কারও নির্বাচন করার সুযোগ নেই- আপিল বিভাগের এই রায়ের কারণে আগেই শঙ্কা ছিল খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল হতে পারে।
তিনি অযোগ্য হলে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে বগুড়া-৭ আসনে আরও তিনজনকে মনোনয়ন দিয়েছিল বিএনপি। গতকাল বাছাইয়ে তাদের সবার মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। তারা হলেন- জেলা বিএনপির উপদেষ্টা হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু, শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সরকার বাদল এবং গাবতলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোর্শেদ মিল্টন।
উপজেলা চেয়ারম্যানের পদে থেকে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ায় সরকার বাদল ও মোর্শেদ মিল্টনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। তবে মোর্শেদ মিল্টন বলেছেন, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগেই তিনি চেয়ারম্যান পদ ছেড়েছেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্র দিয়েছেন। পদত্যাগপত্র গ্রহণের চিঠি দেখানোর পরও তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। তিনি আপিল করবেন।
ঢাকা-১ আসনে বিএনপির দুই প্রার্থী খন্দকার আবু আশফাক ও সায়মা হোসেন জুবিলীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। দলীয় মনোনয়নের প্রত্যয়নে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের স্বাক্ষরে মিল না থাকায় জুবিলীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়।
আবু আশফাকের মনোনয়নপত্র বাতিল হয় উপজেলা চেয়ারম্যান পদ না ছাড়ায়। বাছাইয়ের সময় রিটার্নিং কর্মকর্তাকে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার চিঠি দেখান। রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, পদত্যাগপত্র গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী আবু আশফাক এখনও চেয়ারম্যান পদে বহাল আছেন।
মানিকগঞ্জ-২ আসনে বিএনপির দুই প্রার্থীরই মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। এ আসনে দলটির কোনো বৈধ প্রার্থী নেই। দলীয় প্রত্যয়নপত্রে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের স্বাক্ষরে মিল না থাকায় মইনুল ইসলাম শান্তর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। গতকাল বিকেলে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম জানান, মানিকগঞ্জের সাত প্রার্থীকে তিনিই মনোনয়নের প্রত্যয়ন দিয়েছেন। সবাই তার সুপরিচিত। তাই স্বাক্ষরে মিল না থাকার যুক্তি অবান্তর।
মানিকগঞ্জ-২ আসনে বিএনপির আরেক প্রার্থী আবিদুর রহমান সিঙ্গাইর উপজেলার চেয়ারম্যান। তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে চেয়ারম্যান পদ না ছাড়ায়। তবে আবিদুর রহমানের দাবি, ২৮ নভেম্বর তিনি পদত্যাগপত্র দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে। তার চিঠিও তার কাছে ছিল; কিন্তু রিটার্নিং কর্মকর্তা তার মনোনয়নপত্র গ্রহণ করেননি।
প্রায় সব আসনেই বিএনপি একাধিক প্রার্থী দিলেও জামালপুর-৪ আসনে বিএনপির একমাত্র প্রার্থী ছিলেন ফরিদুল কবির তালুকদার শামীম। বিএনপির সাবেক এমপি আনোয়ারুল কবির তালুকদারের ছেলে শামীম সরিষাবাড়ী উপজেলার চেয়ারম্যান। পদত্যাগপত্র গৃহীত না হওয়ায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। শামীমের দাবি, তিনি ২৮ নভেম্বর পদত্যাগপত্র জমা দিয়েই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বেছে বেছে বিএনপির জনপ্রিয় প্রতিনিধিদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। সরকারের পরিকল্পনা একতরফা। ক্ষমতায় থাকতে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
মানিকগঞ্জে বিএনপির সাত মনোনয়নপত্র বাতিলের প্রতিবাদে ইসিতে চিঠি মানিকগঞ্জের তিনটি সংসদীয় আসনে সাতজনের মনোনয়নপত্র বাতিলের প্রতিবাদ জানিয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) চিঠি দিয়েছে বিএনপি। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বিজন কান্তি সরকার গতকাল ইসিতে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের চিঠিটি পৌঁছে দেন।
চিঠিতে মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘আমি অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে জানাচ্ছি, মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক কর্তৃক দলীয় মনোনয়নপত্রে আমার প্রদত্ত স্বাক্ষর গ্রহণ করছে না, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে জানাচ্ছি, মানিকগঞ্জের প্রতিটি আসনে দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থীরা আমার সুপরিচিত এবং আমি নিজে তাদের মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর করেছি, এ বিষয়ে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।’
মির্জা ফখরুল তার স্বাক্ষরিত প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র গ্রহণ করতে ইসিকে অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে বিজন কান্তি সরকার সাংবাদিকদের বলেন, এটাই সঠিক স্বাক্ষর। সাতশ’ থেকে আটশ’ মনোনয়নপত্রে মহাসচিব স্বাক্ষর করেছেন। স্বাক্ষর একটু এদিক-সেদিক হলেও হতে পারে। কিন্তু নিশ্চিত করার পরও বাতিল করে দেওয়া দুর্ভাগ্যজনক মনে হচ্ছে। মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসকের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, সারবত্তাহীন অভিযোগের কারণে কারও মনোনয়নপত্র বাতিল করাই ?যুক্তিসঙ্গত কথা না। নির্বাচন কমিশনে আলোচনার পর তাদের স্থানীয় রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে আপিল করতে পরামর্শ দিয়েছে ইসি। বিএনপির এ নেতা আশা করছেন, তাদের আপিল হয়তো গৃহীত হবে।
সূত্র: সমকাল