‘সংস্কারপন্থীদের’ নিয়ে বিএনপিতে চলছে ক্ষোভ

বলতে গেলে প্রায় এক যুগ দলের বাইরে। নেতাকর্মীদের সঙ্গেও তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত নেতাদের। অথচ সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে দলে ফিরিয়ে নিয়ে তাদের দেওয়া হয়েছে মনোনয়নের চিঠি। আর এ নিয়ে ক্ষুব্ধ একই আসনে মনোনয়নের চিঠি পাওয়া অন্য নেতা আর বঞ্চিতরা।

দুই দিন ধরে ২৯৫টি আসনে আট শয়ের বেশি নেতাকে মনোনয়নের চিঠি দেয় বিএনপি। সবাইকে জমা দেওয়ার জন্য বলা হলেও ৬৯৬ জন মনোনয়ন জমা দিয়েছেন।

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বেগম খালেদা জিয়াকে দলের চেয়ারপারসনের পদ থেকে সরানোর চেষ্টা হয়েছিল। তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একদল নেতা সংস্কারের দাবি তুলে একজোট হন। সাবেক বেশ কিছু সংসদ সদস্যও সেখানে যোগ দেন, বক্তব্য দেন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে। অথচ এবার ২০ জনের মতো এমন নেতাদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এদের এক ডজনেরও বেশি পেয়েছেন মনোনয়ন।

এসব নেতার সিংহভাগই দলীয় নেতাদের বিরোধিতার কারণে এলাকায় যাচ্ছেন না। তাদের বিরুদ্ধে নানা কর্মসূচিও পালিত হয়েছে। নেতারা কথাও বলছেন প্রকাশ্যে। এদের কারণে আসনগুলো হারাতে হবেÑএমন কথাও বলাবলি হচ্ছে।

বগুড়া-৪ আসনে আরেক সংস্কারপন্থী নেতা জিয়াউল হক মোল্লার সঙ্গে মোশাররফ হোসেনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এই আসনে বিএনপির সবাই জিয়াউল হককে ঠেকাতে একাট্টা।

কাহালু উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব আবদুর রশীদ বলেন, ‘জিয়াউল হক মোল্লার চাচাতো ভাই গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ধানের শীষ নিয়ে ভোট করেছিলেন। কিন্তু জামানত হারান। তাকে বিএনপির লোকেরাও ভোট দেয়নি জিয়াউল হক মোল্লার কারণেই। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনে তিনি কীভাবে ভোট আশা করেন?

বগুড়া-৫ আসনে সংস্কারপন্থী নেতা জি এম সিরাজের সঙ্গে জানে আলম খোকাকে মনোনয়নের চিঠি দেওয়া হয়েছে। যদিও দীর্ঘদিন ধরে মাঠে ছিলেন খোকা। তার বিরুদ্ধে মামলাও আছে। নেতাকর্মীদের বিপদে-আপদে ছিলেন। কিন্তু এই আসনে সিরাজের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

এরই মধ্যে সিরাজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে স্থানীয় বিএনপির একটি বড় অংশ। তাকে মনোনয়ন দিলে মেনে নেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়ে রাজপথে সক্রিয়ও তারা।

জানে আলম খোকা বলেন, ‘যারা আন্দোলন-সংগ্রামে বিগত ১০-১২ বছর এলাকার বাইরে ছিলেন, এলাকার লোকদের সঙ্গে, নেতা-কর্মীদের সঙ্গে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল না, এমন পরিস্থিতিতে তাদের মনোনয়ন দেওয়া হলে বিএনপি তো নয়ই, সাধারণ ভোটাররাও ভোট দেবে না।

ঝালকাঠি-২ আসনে মনোনয়নের চিঠি পেয়েছেন সংস্কারপন্থী ইলেন ভুট্টো ও জেবা খান।

ইলেন গত ১০ বছরে পুরোপুরি দলের বাইরে ছিলেন। আর জেবা ঢাকাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে ছিলেন। বিশেষ করে, বিএনপির কূটনৈতিক জোনে কাজ করতেন।

ওই আসনে আরেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল হক নান্নু মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। অসংখ্য মামলার আসামি নান্নু বর্তমানে কারাগারে। তবে চিঠি পাননি, যা নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ আছে।

নান্নুর স্ত্রী বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তার অভিমানের কথা বলেছেন। করেছেন কান্নাকাটিও।

বরিশালের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নান্নুর মতো একজন নেতা যিনি সব সময় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তিনি চিঠি পাবেন এমন আশা তো সবারই ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেলেন না। এটা হতাশার কথা।’
‘অন্তত চিঠি পেলে নিজের নেতাকর্মীদের কাছে ইমেজটা ধরে রাখার সুযোগ পাওয়া যায়। এতে দলের তো ক্ষতি হতো না।’

বরিশাল-২ আসনে শহিদুল হক জামালের সঙ্গে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টুকে মনোনয়নের চিঠি দেওয়া হয়েছে। সংস্কারপন্থীসহ লম্বা তালিকা দেখে এবং পছন্দের আসন না পাওয়ায় নির্বাচন থেকেই সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন আলাল।

সান্টুর বিরুদ্ধে কম মামলা থাকলেও তার আসনের নেতাকর্মীরা মামলায় জর্জরিত। মামলা পরিচালনাসহ নেতাকর্মীদের সার্বিক দেখভাল করতেন সান্টু।

বরিশাল-১ আসনে জহির উদ্দিন স্বপনের সঙ্গে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে আব্দুস সোবহানকে। এই আসনে আরেক সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন বরিশাল বিভাগ বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান।

সরকারবিরোধী আন্দোলনে সরব ছিলেন কুদ্দুস। তার কর্মী-সমর্থকদের প্রত্যাশা ছিল তিনি মনোনয়ন পাবেন। বেশ কয়েকটি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি আছে।

অন্যদিকে জহির উদ্দিন স্বপন পুরোপুরি এবং আব্দুস সোবহান অনেকটা নিরাপদে ছিলেন এত দিন।

ছাত্রদলের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘অন্তত দলের চিঠি পাওয়ার মতো যোগ্য হলেন না কুদ্দুসুর রহমান। আর এত বছর দলের বাইরে থেকেও মনোনয়ন পাওয়া যায়, এটা দুঃখজনক।’

নরসিংদী-৪ আসনে সরদার সাখাওয়াত বকুলের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েলকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

বকুল ছিলেন সংস্কারপন্থী নেতা। ২০০৮ সালে তাকে মনোনয়ন না দিয়ে বিএনপি প্রার্থী করে জয়নাল আবেদীনকে।

অন্যদিকে ঢাকার রাজনীতিতে বেশি সক্রিয় নরসিংদীর ছেলে জুয়েল ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক। তার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তারও হয়েছেন একাধিকবার। তবে এই আসনে তার মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ তালিকায় এক নম্বরে আছে বকুলের নাম।

স্বেচ্ছাসেবক দলের শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘এ ধরনের খবরে নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা খারাপ বার্তা যায়; যেটা নির্বাচনে প্রভাব পড়ে। কারণ, যে আসন নিয়ে আপনি কথা বলেছেন, সেখানে তার বিরুদ্ধে (জুয়েল) এক শর বেশি মামলা রয়েছে। অথচ যাকে এক নম্বরে দেওয়া হয়েছে (বকুল), সে এত দিন দলেই ছিল না। এটা মেনে নেওয়ার মতো নয়।’

রাজশাহী-৪ আসনে আবু হেনার সঙ্গে নুরুজ্জামান খান মনির ও আব্দুল গফুরকে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। এদের মধ্যে আব্দুল গফুর ঢাকায় থাকলেও মাঝে মাঝে এলাকায় যান। নেতাকর্মীদের সঙ্গেও যোগাযোগ আছে।

বাগমারার ভবানীগঞ্জ পৌর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘যদি সংস্কারপন্থী প্রার্থী মনোনয়ন পায়, তাহলে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রভাব পড়বে। কারণ, আমাদের আসনের এই প্রার্থীকে কর্মীরা ভুলে গেছে। তার কোনো যোগাযোগ নেই।’

গফুরের পক্ষে মনোনয়নপত্র দাখিল করা হাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘আমরা যারা পদ-পদবি নিয়ে আছি, আমাদের ধানের শীষের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কর্মীদের ধরে রাখা কঠিন হবে।’

যশোর-১ আসনে মফিকুল হাসান তৃপ্তির সঙ্গে হাসান জহিরকে মনোনয়নের চিঠি দেওয়া আছে। শার্শা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাসান জহির মাঠে ছিলেন। মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। অন্যদিকে তৃপ্তি দল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন, সংস্কারবাদী ছিলেন। তবে তার মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

হাসান জহির বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে সব মিলে ১৭টি মামলার বিচার চলছে। একাধিকবার জেল খেটেছি। কিন্তু দলের দুর্দিনে নেতাকর্মীদের রেখে গিয়ে কেউ সংস্কারপন্থীদের দলে চলে গেছেন। এখন আবার ফিরে আসছেন। অথচ আমরা ১০ বছর মাঠে ছিলাম। এখন হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত সহজভাবে মেনে নিতে পারছে না কেউ।’

শেষ পর্যন্ত তৃপ্তি চূড়ান্ত মনোনয়ন পেলে কর্মীদের কষ্ট আরও বেশি হবে বলে মনে করেন বিএনপির এই নেতা।

নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে সংস্কারপন্থী নেতা আবুল কালাম ও মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তালিকায় প্রথমে রাখা হয়েছে আবুল কালামকে।

মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৯১টি। জেল খেটেছেন পাঁচবার। অথচ তালিকায় তার নাম পরে দেখে ক্ষোভ ঝেড়েছেন তিনি।

খোরশেদ বলেন, ‘যারা দুর্দিনে দলের সঙ্গে বেইমানি করেছে, তাদের প্রতি ক্ষোভ আছে। তাদের নিয়ে বক্তব্যও আছে।’
নারায়ণগঞ্জ-২ আসনে আতাউর রহমান আঙ্গুর। তার সঙ্গে এখানে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সাবেক সংসদ সদস্য মাহমুদুর রহমান সুমন ও নজরুল ইসলাম আজাদকে। এই আসনে আঙ্গুরের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তিনি ছিলেন সংস্কারপন্থী। তাকে নিয়েও আছে আপত্তি। তবে প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না তারা।

নওগাঁ-৬ আসনে আলমগীর কবিরের সঙ্গে শেখ রেজাউল ইসলাম রেজুকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এই আসনে দীর্ঘদিন ধরে দলের নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য আনোয়ার হোসেন বুলু। মনোনয়ন চেয়েছিলেন কিন্তু পাননি। যা নিয়ে স্থানীয় বিএনপিতে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবে এ নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে সতর্ক সেখানকার দায়িত্বশীল নেতারা। দফায় দফায় বৈঠক করে এসব বিষয় নিয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া কথা বলতেও বারণ করা আছে।

পটুয়াখালী-২ আসনে শহিদুল আলম তালুকদারের জায়গা বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক মুনির হোসেনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এই শহিদুল আলমের স্ত্রী সালমা আলমকেও মনোনয়নের চিঠি দিয়েছে বিএনপি। এই আসনে শহিদুল আলমের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘দল অনেক বিষয় চিন্তাভাবনা করে মনোনয়ন দিয়েছে। এই মুহূর্তে বিভেদ নয়, জয়ী হতে পারবেন এমন প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করি, সবাই দলের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন।’

সূত্র: ঢাকা টাইমস