যে সকল কারণে নির্বাচনের দুয়ার বন্ধ হয়ে গেছে তাদের জন্য

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ ডজনখানেক দ-প্রাপ্ত রাজনীতিক নেতার আপিল বর্তমানে সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন। তারা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে মনোনয়নপত্রও নিয়েছেন। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন এমন নেতাও রয়েছেন। এ অবস্থায় গতকাল মঙ্গলবার হাইকোর্ট এক আদেশের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ফৌজদারি অপরাধে অন্যূন দুই বছরের দ-প্রাপ্তদের আপিল বিচারাধীন থাকলেও তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিম, বিএনপি নেতা ও সাবেকমন্ত্রী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মীর মোহাম্মদ নাছির, আমানউল্লাহ আমান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, বিএনপি ও ড্যাব নেতা ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, সাবেক এমপি আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, আব্দুল ওহাব, মশিউর রহমান, ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, একেএম মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মীর হেলালের দণ্ডের বিরুদ্ধে করা আপিল সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের ভাষ্য অনুযায়ী, দণ্ডিত এসব নেতা আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। গতকাল হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণের পর অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য অনুযায়ী সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বর্তমান সরকারের মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, কেউ ফৌজদারি মামলায় অন্যূন ২ বছর দণ্ডিত হলে ওই দ- থেকে মুক্তি লাভ বা সাজা বাতিলের পর থেকে ৫ বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এমনকি খালেদা জিয়া যদি এখন খালাসও পেয়ে যান, তার পরও তাকে নির্বাচনের জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

উল্লেখ্য, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একটি দুর্নীতির মামলায় ৩ বছরের দ- থেকে গতবছর খালাস পেয়েছেন। এ ছাড়া মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী ৮ অক্টোবর একটি মামলায় ১৩ বছরের দণ্ড থেকে হাইকোর্টে খালাস পেয়েছেন।

আসামিপক্ষের দাবি, এর আগে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নজির রয়েছে। তাই বিষয়টি এখন আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হবে। আপিল বিভাগ এখন তাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে কী আদেশ দেন, তার অপেক্ষায় থাকতে হবে। আপিল বিভাগ যদি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেন, তা হলে আপিল বিচারাধীন দণ্ডপ্রাপ্ত এসব আসামির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না। এ অবস্থায় আপিল বিচারাধীন এসব দ-প্রাপ্ত আসামি নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন কিনা, সে ব্যাপারে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।

জানতে চাওয়া হলে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল তার এক রায়ে বলেছেন, নির্বাচন করা সাংবিধানিক অধিকার এবং আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দিতে হবে। আইন হচ্ছে দুই বছর সাজা হলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। এ ব্যাপারে বিচারপতি মোস্তফা কামাল তার রায়ে বলেছেন, আপিল হলো বিচারের চলমান প্রক্রিয়া। কোনো দণ্ডই চূড়ান্ত হবে না, যতক্ষণ না আপিল বিভাগ চূড়ান্ত করে।’ তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, ‘মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামির আপিল বিচারাধীন থাকলে তার ফাঁসি কার্যকর হয় না। তাই আপিল বিচারাধীন থাকলে কারও শাস্তি চূড়ান্ত হয় না, যতক্ষণ আপিলে চূড়ান্ত ফয়সালা না হয়। এখন আপিল বিভাগই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবে।’

জানা গেছে, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয়টি সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে। এই অনুচ্ছেদের (২) (ঘ) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে’, তা হলে তিনি নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য হবেন। আবার গণপ্রনিতিধিত্ব অধ্যাদেশেও (আরপিওতেও) একই কথা বলা হয়েছে।

এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আপিলে দণ্ড স্থগিত হলে দ-প্রাপ্তরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। সে অনুযায়ী দণ্ডপ্রাপ্ত ও জামিনে থাকা আমানউল্লাহ আমানসহ পাঁচ বিএনপি নেতা হাইকোর্টে দণ্ড স্থগিতের আবেদন করেছিলেন। হাইকোর্ট গতকাল আবেদনগুলো খারিজ করে তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ‘সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদে অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারও অন্যূন দুই বছর কারাদ- হলে এবং তার মুক্তির পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। কোনো আদালতের দেওয়া সাজার বিরুদ্ধে আপিল বিচারাধীন থাকলেও দণ্ড বাতিল না হওয়া পর্যন্ত দ-টা কার্যকর থাকে। এটা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরোপুরি বাধা। ফৌজদারি কার্যবিধিতে যা কিছুই থাকুক না কেন, এক্ষেত্রে সংবিধানের বিধানই প্রাধান্য পাবে।’

বিএনপি নেতারা আশা করছিলেন, বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে এবং উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে অতীতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নজির থাকায় তারাও একইভাবে আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। এদিক বিবেচনায় নিয়ে দুটি মামলায় ১৭ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ফেনী-১, বগুড়া-৬ ও বগুড়া-৭ আসন থেকে মনোনয়ন নিয়েছেন। দুদকের মামলায় দ-প্রাপ্ত ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ঢাকা-১৬ থেকে, হাজী সেলিম ঢাকা-৭ থেকে, আমানউল্লাহ আমান ঢাকা-২, শাহজাহান ওমর ঝালকাঠি-১, একেএম মোশাররফ হোসেন ময়মনসিংহ, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন ও তার ছেলে মীর হেলাল চট্টগ্রাম-৫ থেকে, আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া খাগড়াছড়ি-১, আবদুল ওয়াহহাব ও মশিউর রহমান ঝিনাইদহ থেকে, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সিরাজগঞ্জ-১, ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী কুমিল্লা-৪ থেকে নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন আজ বুধবার। মনোনয়নপত্র বৈধ না অবৈধ, তা জানা যাবে আগামী ২ ডিসেম্বর। এর পর নির্বাচন কমিশন ও উচ্চ আদালতে মনোনয়নপত্রের বৈধতা নিয়ে আপিল করা যাবে। তখন আপিল বিভাগ থেকে বিষয়টি নিয়ে একটা চূড়ান্ত ফয়সালা আসতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।

এর আগে বিচারিক আদালতে দণ্ডিত হওয়ার পর আপিল করে নির্বাচন করার নজির আছে, উল্লেখ করে আসামিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম জানিয়েছেন, দুর্নীতির মামলায় ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি আদালত ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীকে ১৩ বছর কারাদ- দেন। এ ছাড়া সে সময় দণ্ডপ্রাপ্ত হন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরও। তারা দণ্ডপ্রাপ্ত অবস্থায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন এবং পরে মন্ত্রীও হন। এ ছাড়া হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জনতা টাওয়ার মামলায় নিম্ন আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে থাকা অবস্থায় আপিল করে ১৯৯৬ সালে সংসদ নির্বাচন করেছিলেন। এ ছাড়া দণ্ডপ্রাপ্তদের আপিল করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার ভারতের সুপ্রিমকোর্টেরও নজির রয়েছে। এত নজির থাকার পরও হাইকোর্টের এ ধরনের আদেশ দুঃখজনক। সে কারণে আমরা আপিল বিভাগে যাব।

সাবেক মন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েও এবং এরশাদ কারাগার থেকে নির্বাচন করে নির্বাচিত হয়েছিলেন, এমন প্রশ্নে গতকাল অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এরশাদের বিষয়ে তো আমাদের সুপ্রিমকোর্টেরই রায় আছে। তার যে পদ সেটা খারিজ হয়ে গিয়েছিল। মহীউদ্দীন খান আলমগীর বা মায়া তাদের ব্যাপারে সেই সময় এ সাবমিশনগুলো রাখা হয়েছিল কিনা, এটা আমি বলতে পারব না। সেই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যাখ্যায় এখন আমি যাব না। আমার সামনে যে মামলাগুলো আছে এসব মামলায় আমার বক্তব্য হচ্ছে এটি।