সৌদি আরবের সমাজ ও নৈতিকতা নিয়ে এ দেশের মানুষের মনে থাকা ধারণা এখন প্রতিদিনই ধাক্কা খাচ্ছে। সৌদিফেরত নারী গৃহকর্মীরা প্রায় নিয়মিত আমাদের বিমানবন্দরে নামছেন। তাঁদের শরীর-মন বইছে অকথ্য নিপীড়নের চিহ্ন। সৌদি আরবে তাঁদের ওপর চলা লোমহর্ষক নির্যাতনের বিবরণ গণমাধ্যমে আসছে।
ভুক্তভোগী নারীদের মধ্যে কেউ বলছেন, তাঁদের আটকে রাখা হতো। কারও অভিযোগ, খাবার দেওয়া হতো না। কেউ মারধরে শিকার হয়েছেন। কারও শরীরে জখমের দাগ। আছেন অন্তঃসত্ত্বাও। সৌদিফেরত নারীদের মধ্যে সবাই যে ঠিকমতো কথা বলতে পারছেন, তা-ও নয়। কেউবা এসেছেন মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে।
সৌদিফেরত নারীরা কোনোমতে জান নিয়ে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে পা রাখতেই আরেক দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। পরিবারের ভাগ্যবদলের স্বপ্ন নিয়ে এই নারীরা একদিন সৌদি আরব পাড়ি জমিয়েছিলেন। অথচ তাঁদের অনেকেই দেশে ফিরে এখন পরিবার পাশে পাচ্ছেন না। সমাজের দোহাই দিয়ে তাঁদের গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে পরিবার। যাঁরা বাড়িতে ফিরছেন, তাঁরাও কঠিন পারিবারিক ও সামাজিক চাপে ভঙ্গুর অবস্থায় আছেন। এমনকি সরকারি সংস্থাও তাঁদের পাশে নেই। বলতে গেলে অকূলপাথারে পড়ার মতো অবস্থা তাঁদের।
অবস্থা উদ্বেগজনক। ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্য বলছে, চলতি বছরের সাত মাসে প্রায় দেড় হাজার নারী গৃহকর্মী সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন। সে দেশে তাঁরা সবাই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
গত তিন বছরে বাংলাদেশ থেকে দুই লাখের বেশি নারী গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব গেছেন। এ পর্যন্ত দেশে ফিরেছেন প্রায় ছয় হাজার নারী কর্মী। যাঁরা দেশে ফিরেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা ভয়াবহ হলেও আমাদের কর্তাব্যক্তিদের কথায় তা বোঝার উপায় নেই। ৯ জুলাই জাতীয় সংসদে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বলেন, সৌদি আরবে বাংলাদেশের নারী কর্মীরা বর্তমানে ভালো আছেন। সরকারের পদক্ষেপে অত্যাচার-নির্যাতন অনেক কমেছে। যাঁরা ফেরত এসেছেন, তাঁরা আবার যেতে চান।
মন্ত্রীর এমন দাবির পরও (৯ জুলাইয়ের পর) সৌদি আরবে নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক নারী দেশে ফিরেছেন। ২১ জুলাই রাতে ৪৩ জন নারী সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন। তাঁদের একজন জানান, কোমরে ইনজেকশন দেওয়ার পর তাঁর সঙ্গে কী করা হতো, তা তিনি জানতেন না। এই দলে আসা অন্তঃসত্ত্বা একজন নির্যাতনের কথা ভুলে এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায়। তিনি জানেন না কোথায় যাবেন, কী করবেন! ২২ জুলাই ১৮ জন নারী সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন। তাঁদের শরীরেও নির্যাতনের ক্ষত। ২৭ জুলাই ফিরেছেন আরও ৪২ জন নারী গৃহকর্মী। এই হচ্ছে সৌদি আরবে বাংলাদেশের নারী কর্মীদের ভালো থাকার নমুনা!
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের কথা হলো, বাংলাদেশের নারী গৃহকর্মীদের নির্যাতনের ঘটনায় সৌদি নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির তেমন কোনো তথ্য আমরা পাই না। যদি মামলা না হয়, বিচার না হয়, শাস্তি না হয়, তাহলে সৌদি নিয়োগকর্তারা দুর্ধর্ষ তো হবেনই!
নারী গৃহকর্মীদের প্রতি সৌদি নিয়োগকর্তাদের বর্বর আচরণের খাসলত নতুন নয়। নির্যাতন-নিপীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ বেশ কিছু দেশ সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দেয়। বিপদে পড়ে তারা বাংলাদেশমুখী হয়। সব জেনেশুনেও সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠাতে রাজি হয় বাংলাদেশ সরকার। চাপে পড়ে হোক, আর যা-ই হোক, সস্তা শ্রম ও দুর্বল সুরক্ষায় গৃহকর্মী হিসেবে দরিদ্র নারীদের পাঠানোর ‘ফল’ আমরা পেতে শুরু করেছি। সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স আসছে। রেমিট্যান্সে আমরা ফুলে উঠছি। সগর্বে দিকে দিকে প্রচার করছি। কিন্তু এই রেমিট্যান্সের প্রবাহে মিশে আছে আমাদের মা-বোনদের ক্ষতবিক্ষত শরীর, হারানো ‘সম্ভ্রম’—এক বুক দীর্ঘশ্বাস।
সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীদের নির্যাতনের শিকার হওয়ার কারণ বুঝতে কথা হয় ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসানের সঙ্গে। সৌদি নিয়োগকর্তাদের মনস্তত্ত্বকেই প্রথমে দায়ী করেন তিনি। তাঁর কথার মর্মার্থ হলো—সৌদি নিয়োগকর্তাদের মধ্যে অনেকে নারী গৃহকর্মীদের কেনা দাস হিসেবে গণ্য করেন। সে অনুযায়ী তাঁরা নারী গৃহকর্মীদের সঙ্গে যা ইচ্ছা তা করেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে গৃহকর্মী হিসেবে নারীদের পাঠানোর যৌক্তিকতা নিয়েও তাঁর প্রশ্ন আছে। তা ছাড়া নারী কর্মীদের সুরক্ষা এবং প্রতিটি নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনার বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের দুর্বলতাকেও বড় করে দেখছেন তিনি।
কাজের এত এত ক্ষেত্র থাকতে আমাদের দেশের নারীদের কেন গৃহকর্মীর কাজ করতে সৌদি আরবে পাঠাতে হবে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তা পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। সৌদি নিয়োগকর্তাদের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে আমাদের নারী কর্মীদের কুংফু শিখিয়েও সে দেশে পাঠালে নির্যাতন ঠোকানো যাবে না। আর নির্যাতনের বিচার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারকেই শক্ত ভূমিকা নিতে হবে। তা না হলে নির্যাতনের গল্প শুনে শুনে আমাদের দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হবে।