নারায়ণগঞ্জে পাটের সেই বাজার নেই

এক সময়ে প্রাচ্যের ড্যান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জ পাটের জন্য বিখ্যাত ছিল। গত দেড় দশকেরও বেশি সময় আগে আদমজী জুটমিল বন্ধ করে দেয়ার পর ধীরে ধীরে নারায়ণগঞ্জ থেকে পাটের ব্যবসা চলে যায় খুলনায়।

এরই মধ্যে এখনও কয়েকটি পাটকল নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এদের মধ্যে কুমুদিনী ও পপুলারের নাম বলা চলে। কুমুদিনী ট্রাস্টের দোতলা প্রেস কারখানা ভবনের দুই পাশে বিশাল আকারের ৩৮টি গুদাম। গুদামগুলোর আয়তন সাড়ে ৫ লাখ বর্গফুট। সেখানে যাচাই-বাছাই শেষে শ্রমিকেরা মাথায় করে পাট নিয়ে যাচ্ছেন কারখানার ওপরের তলায়। তারপর সেই পাট ওজন করে দৈতাকার প্রেস মিশিনের একটি অংশে রেখে মোটা দড়ি দিয়ে প্যাঁচানো হয়। তারপর মেশিনে চাপ প্রয়োগ করে বেল আকার দেয়া হয়। প্রতি বেলে ১৮২ কেজি পাট থাকে। মেশিন থেকে প্রতি বেল স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিচতলায় চলে যায়। তারপর নির্দিষ্ট ট্রলিতে করে সেগুলো আবার রফতানির জন্য গুদামে নিয়ে রাখা হয়। ট্রলি চালানোর জন্য পুরো কারখানা চত্বরে রয়েছে রেললাইন।

আবার বিভিন্ন এলাকা থেকে নদীপথে কাঁচা পাট আনার জন্য কারখানার ভেতর পর্যন্ত শীতলক্ষ্যা নদীর একটি চ্যানেল আছে। পাটবাহী ট্রলার কিংবা বড় নৌকা চ্যানেল দিয়ে কারখানায় আসে। নারায়ণগঞ্জ শহরের খানপুর এলাকার কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল (বিডি) লিমিটেডের জুট বেলিং কারখানার ভেতরের চিত্র এটি। কারখানা চত্বর ঘুরে দেখা যায়, অল্প কয়েকটি গুদামে ৩-৪জন করে শ্রমিক পাট যাচাই-বাছাইয়ে কাজ করছেন। কিছু গুদাম ফাঁকা। তবে প্রেস হাউস বেশ কর্মচঞ্চল। দুটি প্রেস মেশিনে প্রায় অর্ধশতাধিক শ্রমিক কাজ করছেন। গুদাম থেকে কারখানায় পাট আনতে ব্যস্ত আরও অর্ধশতাধিক শ্রমিক। সবারই পুরো শরীর পাটের সোনালি আঁশে মাখামাখি। ৩০ বছর ধরে কারখানার প্রেস মিশিন চালানোর কাজ করেন শ্রমিক মো. ইয়াসিন।

তিনি বলেন, বর্তমানে কাজ কম থাকায় কারখানাটি ৬ ঘণ্টা চলছে। তবে পাটের ভরা মৌসুম আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ মাস কারখানায় ৮-১০ ঘণ্টা জুট বেলিংয়ের কাজ হবে। কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট আগে কাঁচা পাট রফতানি করলেও বর্তমানে করে না। তাদের জুট বেলিং কারখানা চত্বরের ৩৮ গুদাম ভাড়া নিয়েছে ১২ রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান। তারাই কুমুদিনীর প্রেস মেশিন ব্যবহার করে পাটের বেল তৈরি করে। প্রতি বেলের জন্য গুণতে হয় ২৩৫ টাকা। জানতে চাইলে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পুরোনো কর্মকর্তা জগন্নাথ পোদ্দার বলেন, কারখানায় আগে প্রতিদিন ৮০-৮৫ হাজার মণ পাট আসত। দিন-রাত মিলিয়ে ১৬ ঘন্টা কাজ হতো। এখন সকালে চালু করলে দুপুরে বন্ধ করে দিতে হয়। এই হচ্ছে অবস্থা।

তিনি বলেন, ‘আমাদের কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৩ লাখ বেল। কিন্তু ১ লাখ ২৫ থেকে ৩০ হাজার বেলে বেশি বর্তমানে হচ্ছে না। ব্যবসা মন্দা, তাই ৪ টি প্রেস মেশিনের মধ্যে ২ টি চালানো হচ্ছে। কিছু গুদাম তুলা ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছে। প্রাচ্যের ড্যান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জের কাঁচা পাটের ব্যবসায় বহুদিন ধরেই মন্দা চলছে। বহির্বিশ্বে চাহিদা কমে যাওয়ায় কাঁচা পাট রফতানি কমে গেছে। নারায়ণগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, কাঁচা পাট রফতানি কমে যাওয়ায় রফতানিকারীদের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। সরকারি ৭টি প্রেস হাউস বন্ধ। বেসরকারি পর্যায়ে ৭টি প্রেস হাউস চালু থাকলেও প্রায় সবগুলোই চলছে খুঁড়িয়ে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১৬ কোটি ৭৮ লাখ ডলারের কাঁচা পাট রফতানি হয়। বিদায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ কাঁচা পাট রফতানি কমে ১৫ কোটি ৫৬ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। অর্থাৎ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের চেয়ে গত অর্থবছরে রফতানি কমেছে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ।

বাংলাদেশের কাঁচা পাট রফতানির গন্তব্য পাকিস্তান, ভারত, চীন, নেপাল, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভিয়েতনাম, হংকং, তিউনিসিয়া, আইভরি কোস্ট, এল সালভেদর ও ফিলিপাইন। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা এলাকায় কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের আরেকটি জুট বেলিং কারখানা ছাড়াও পপুলার জুট এক্সচেঞ্জ কারখানা আছে। ২ জুলাই কারখানাটিতে ঢুকতেই প্রেস হাউস চোখে পড়ল। পাশেই সারি সারি গুদাম। নদীর পাড়ে পাটবাহী ট্রলার ভেড়ার জন্য আছে নিজস্ব জেটি। কারখানা ঘুরে দেখা গেল, শ্রমিকেরা বেল করা পাট ট্রলিতে করে নিয়ে গুদামে রাখছে। গুদামে পাটের গ্রেডিংয়ের কাজ করছেন বেশ কিছু শ্রমিক। কারখানাটিতে ৪০০ শ্রমিক কাজ করেন। বর্তমানে পাটের ভরা মৌসুম না হওয়ায় কয়েকটি গুদাম গম রাখার জন্য ভাড়া দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পপুলার জুট এক্সচেঞ্জ নিজেরাই কাঁচা পাট বেল আকারে রফতানি করে।

নারায়ণগঞ্জের পাশাপাশি খুলনার দৌলতপুর, সৈয়দপুর, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় পাটের ব্যবসা আছে প্রতিষ্ঠানটির। সর্বোচ্চ রপ্তানিকারক হিসেবে কয়েক দফা জাতীয় রপ্তানি ট্রফি পুরস্কার পেয়েছে পপুলার।

প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (রপ্তানি) স্বপন কুমার রায় বলেন, হঠাৎ করে পাটের দাম মণপ্রতি ৩০০-৪০০ টাকা বেড়ে যাওয়ায় খুব মুশকিলে আছি। কারণ এই বাড়তি দাম তো ক্রেতারা দিবেন না। তিনি বলেন, ‘কাঁচা পাটের ব্যবসা মন্দা চলছে। গত অর্থবছর ২ লাখ ৮৮ হাজার বেল কাঁচা পাট রফতানি করেছি আমরা। কিন্তু কয়েক বছর আগেও আমাদের রপ্তানি ছিল ৪-৫ লাখ বেল।’ কাঁচা পাট রফতানিকারকদের সমিতি বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) রেজিস্ট্রার কার্যালয় আছে নারায়ণগঞ্জে।

সেখানে গিয়ে সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো. দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘বহির্বিশ্বে পাটের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে ব্যবসা পড়ে গেছে। আবার সরকারের নীতির কারণেও আমরা ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। যেমন ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৫ মাস সব ধরনের কাঁচা পাট রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল মন্ত্রণালয়। তখন বিদেশি অনেক ক্রেতা আমরা হারিয়েছি। তারা অন্য দেশ থেকে পাট কেনায় ঝুঁকে পড়েন। চলতি বছর আবার ৩ ধরনের কাঁচা পাট রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।’ দেলোয়ার হোসেন আরও বলেন, মন্ত্রণালয়ের উচিত রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করে বরং নতুন বাজার খোঁজা। তাহলে রফতানি আয় বাড়বে। ব্যবসায়ীরাও বাঁচবেন।