বাংলাদেশে নারীরা এখন একাই বেরিয়ে পড়তে চায়। পর্যটনের প্রতি তাদের আগ্রহ এখন বেশ বেড়েছে। কাজের ফাঁকে কখনো একা, কখনো গ্রুপভিত্তিক হয়ে দেশের বিভিন্ন পর্যটন স্পটে ঘুরে বেড়াচ্ছে নারীরা। বাংলাদেশে পর্যটনের অপার সম্ভাবনায় নারীর এই অগ্রযাত্রা সামাজিক ও আর্থিকভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
পিছিয়ে পড়া নারী যখন সকল বাধা ডিঙিয়ে একাই ঘর হতে বেরোতে চায়, তখন এটি স্পষ্ট যে পর্যটন নারীকে টানছে। আর্থিক ও সামাজিকতার সম্মুখভাগে চলে এসেছে নারী। যথেষ্ট আর্থিক স্বাবলম্বী হওয়ার কারণেই নারীরা এখন বেরিয়ে পড়তে চায় একা, তার নিজের মত করে, পছন্দের জায়গায়। এ এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
সরেজমিন কয়েকটি স্পটে দেখা গেছে, নারীর পদচারণা বাড়ছে। পারিবারিকভাবে হোক, বন্ধুদের সঙ্গে কিংবা সমাজকর্মে, অফিসিয়াল কাজেও নারী ঘর হতে বের হয়ে তার পর্যটন স্বাদ গ্রহণ করতে দেখা গেছে। তখন নারীর নিরাপত্তা সমাজের আর সকলের নিরাপত্তার সঙ্গেই সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। এখন আরো একধাপ এগিয়ে আলোচনায় এসেছে নারীর একা ভ্রমণ, নারীর নিশ্চিত নিরাপত্তা। নারী পর্যটক শায়লা তুলি সম্প্রতি ঘুরে এসেছেন বান্দরবান। তিনি জানালেন, আগে নারীর একা ঘর থেকে বেরুবার বিষয়টি ছিল অকল্পনীয়। এখন এই শহরেই রাত কি দিন, নারীরা একজন পুরুষের সমান ঝামেলা নিয়েই কর্মব্যস্ত সময় কাটান। এই নারীদের জন্যই বিনোদন, বিশ্রাম কিংবা অবসরের জন্য নিরাপদ ভ্রমণ এখন সময়ের দাবি। কোলাহল থেকে দূরে, ছুটির সময়ে যদি নিজেকে ভিন্নভাবে আবিষ্কার করা যায়, প্রকৃতির মাঝে বিলীন হয়ে প্রফুল্লচিত্তে ঘরে ফেরা যায় তবে সেটা জাতীয় অর্থনীতির জন্যই সুখকর এবং ইতিবাচক ফল বয়ে আনে। পূর্ণোদ্যমে কাজে ফিরলে তার উত্পাদনশীলতা বহুগুণে বেড়ে যায়।
একইভাবে ভ্রমণ জগতে নারীর অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করা গেলে বিদেশি নারী পর্যটকরাও একা এদেশে আসতে আরো বেশি আগ্রহী হবে। যা সাথে করে নিয়ে আসবে বৈদেশিক মুদ্রা। শক্তিশালী হবে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। শুধু কি তাই, বেকারত্বের এই দেশে কর্মসংস্থানও অনেক বেড়ে যাবে। ডাবলডিজিট প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য শুধু এই এক পর্যটননির্ভরতাই যথেষ্ট।
শুধু যে পর্যটক হিসাবে নারী তা নয়, নারীরাও এখন এগিয়ে এসেছে পর্যটন সেবা দিতে। এমনি এক উদ্যোক্তা কানিজ ফাতিমা জানালেন, নারীরা এখন আগের চেয়ে শিক্ষা, কর্ম ও সামাজিকভাবে অগ্রসর হয়েছে। ফলে, তারা একাই বের হতে চায়। অভিভাবকদের চিন্তা-চেতনায়ও এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। তবে নারীর জন্য নারীবান্ধব পর্যটন সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে অভ্যন্তরীণ ভাবেই বাংলাদেশ ভাল আয় করতে পারবে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তায় ইতিমধ্যে ট্যুরিস্ট পুলিশ হয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি ভাবে পর্যটন আকর্ষণে নানা কাজ হচ্ছে। গড়ে তোলা হচ্ছে কমিউনিটি ভিত্তিক পর্যটন এলাকা। ট্যুর অপারেটর, ট্যুর গাইডের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। অনেক তরুণ এখন পেশা হিসাবেই বেছে নিচ্ছে এই পেশা। বলা হচ্ছে— বাংলাদেশকে পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরতে এবং প্রয়োজনীয় সেবা সুবিধাদি নিশ্চিত করতে এখাতে আরো কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। রয়েছে বিনিয়োগেরও সুযোগ। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভাগ খুলে শিক্ষার্থী ভর্তি করাচ্ছে। এতে ছেলেরাই শুধু নয়, মেয়েরাও পড়ছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, পর্যটন স্পটগুলোকে আরো বেশি নারীবান্ধব করতে পৃথক বিশ্রামাঘার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ট্যুরিস্ট পুলিশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নারী সদস্যসহ পর্যটনখাতের অন্য সেবাসমূহে বেশি সংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ জরুরি। এক কথায় নারীর জন্য নিরাপদ ও পর্যাপ্ত পর্যটন সেবার গুরুত্ব মাথায় রেখেই নীতি প্রণয়ন এবং অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। পাশাপাশি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে নারীকে নারী না ভেবে একজন পর্যটক হিসাবেই দেখতে হবে। এটি শুধু পর্যটনের জন্যই নয়, সার্বিক অর্থনীতি ও বিনিয়োগ আকর্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা জানবে এদেশে একজন নারী একা ভ্রমণ করতে পারেন, তারা সঙ্গতকারণেই ভাববেন দেশটি বেশ নিরাপদ এবং বিনিয়োগের জন্য উত্তম স্থান। আর এই প্রক্রিয়ায় আমরা উন্নত দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে পাড়ি দিতে সক্ষম হব।