মন্টু হারিয়েছেন অনেক কিছু। ভাড়াবাসায় থাকতেন। বাসা বদলের সময় এটা বেশি ঘটত। কুপি ছাড়াও আরো অনেক কিছুরই সংগ্রহ ছিল তাঁর। যা হোক, এখন মিরপুরে নিজেদের বাড়ি। বাড়িটিতেই মন্টুর সংগ্রহশালা।
একটা অভিযান
সংগ্রহের ঝোঁক মন্টুর ছোটবেলা থেকেই। স্কুলের বার্ষিক প্রদর্শনীতেও দুর্লভ জিনিস প্রদর্শন করতেন। একবার পুরস্কারও জিতেছিলেন। সংগ্রহ করতেন নানা কিছুু। শেষে কুপির দিকেই নজর দিলেন বেশি। মন্টুদের গ্রামের বাড়ি পাবনায়। প্রতিবারই কোরবানির ঈদে যান। গেছেন সেবারও। কোরবানির গরু কেনা হয়ে গেছে। হাতে সময় আছে কিছু। ঘুরতে ঘুরতে পুরনো মাটির হাঁড়ি-পাতিলের দোকানে গেলেন। গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মাটির কুপিবাতি আছে? দোকানি বেশি আগ্রহ দেখালেন না। বললেন, ওই দিকটায় খুঁজে দেখুন। পেতেও পারেন।
মন্টু মাটির জিনিসের স্তূপটির দিকে এগিয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর পেয়েও গেলেন একটি কুপিবাতি। এত খুশি হলেন যেন তিনি কলম্বাস, ডাঙ্গা পেয়েছেন দীর্ঘ জলযাত্রা শেষে। এমন ঘটনা তাঁর জীবনে অনেক।
একজন বিশেষ
ইয়ার মোহাম্মদ সানি। পুরান ঢাকার মানুষ। কাঁসা-পিতলের ব্যবসা করেন। মন্টু তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। সানি যখনই বিশেষ কিছুর সন্ধান পান, মন্টুকে খবর পাঠান। কুপিবাতির খবর পেলে তো কথাই নেই। দেরি সয় না মন্টুরও। খবর পেলেই ছোটেন। মন্টুর সখ্য আছে আরো এমন কয়েকজনের সঙ্গে। কুপি দেখলে তাঁরা মন্টুকে খবর পাঠান বা লোক মারফত পৌঁছে দেন।
কুপির রকমফের
একেক সময়ের কুপি একেক রকম। আবার ঘরে ব্যবহারের এবং নৌকায় ব্যবহারের কুপি আলাদা। কুপির ধরনি, গলা বা মাথায় পরিবর্তনটা বেশি চোখে পড়ে। অনেক সময় পুরোটাই ভিন্ন। গৃহস্থালি কুপিরও আবার নানা রকম হয়। শোয়ার ঘর আর রান্নাঘরের কুপি যেমন আলাদা। মন্টু দাবি করেন, ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রায় সব রকম কুপি তাঁর সংগ্রহে আছে। সংখ্যাটা দুই শ ছাড়াবে। গৃহস্থালি, নৌকা থেকে শুরু করে দোকানের কুপি, বিচার-সালিসের কুপি, শৌখিন কুপিও আছে তাঁর সংগ্রহে। ভিন্নতা আছে কুপি তৈরির উপকরণেও। কিছু যেমন মাটির। এ ছাড়াও আছে পিতলের, টিনের, তামার, জার্মান সিলভারের, ব্রোঞ্জ ও কাচের তৈরি কুপি। তবে তামা, জার্মান সিলভার, ব্রোঞ্জ ও কাচের তৈরি কুপি দেখতে সুন্দর হয় বেশি। কুপির নকশাও দেখার মতো। অনেক রকম নকশা হয়—বিমানমতো, স্টিমারমতো, কামরাঙা আকৃতির, বাল্বমতো বা চায়ের কেটলির মতো। জগ আকৃতির, মাছ আকৃতির কুপিও দেখবেন মন্টুর কাছে। এসব কুপি সাধারণত শৌখিন লোকে ব্যবহার করত। কুপির সলতেয় কাপড় বা দড়ি ব্যবহার করা হয়। কুপির জ্বালানি হিসেবে প্রাণীর চর্বি, কেরোসিন তেল ব্যবহার করা হতো। মজার ব্যাপার হলো, কুপির সলতেতেও অনেক রকম নকশা লক্ষ করা যায়।
মন্টু কিছু বললেন
বৈচিত্র্য বেশি দেখি ধরনিতে (কুপি ধরার জায়গায়)। চাবির রিঙের মতো গোল ধরনি হয় বেশি। এগুলোর কোনোটি এক আঙুল দিয়ে ধরার মতো গোল। কোনোটির ভেতর আবার দুই আঙুলও ঢোকানো যায়। ইংরেজি এস অক্ষরের মতো ধরনিও আছে। কিছু কুপির ধরনি দেখি চামচের মতো। কিছুু কুপিতে আবার ধরনিই নেই। অনেক কুপিতে নাম খোদাই করা থাকত। পিতলের কুপিগুলোতেই এটা বেশি দেখি। এর ফলে হারিয়ে যাওয়া ঠেকানো যেত।
ছেলেরাও আগ্রহী
পেশায় ব্যবসা। স্ত্রী সাদেকা খাতুন এবং দুই সন্তান তাহমিদ মুশফিক ও তানজীম সালেহ। ছেলেরা আর স্ত্রীও তাঁর সংগ্রহের প্রতি খেয়াল রাখে। ছেলেরা পালা করে কুপিগুলো পরিষ্কার করে, যত্ন নেয়। মন্টুর স্বপ্ন, পাবনায় একটি জাদুঘর করবেন। কুপির জাদুঘর।