১৯৭৮ সালের কথা। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের খারুয়া মুকুন্দ গ্রামের ইন্তাজ আলী-সমতা খাতুন দম্পতির অভাবের সংসার। সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে পাড়তেন না তারা। একদিন দুই মেয়ে সন্তান সাজেদা ও মল্লিকাকে গফরগাঁও রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে যায়। সেখান থেকে মেয়ে দুটিকে ঢাকাগামী একটি ট্রেনে তুলে দিয়ে ‘বিস্কুট ও চকলেট’ কিনতে যাওয়ার কথা বলে চলে যান বাবা ইন্তাজ।
ট্রেনটি টঙ্গী স্টেশনে থামলে স্থানীয় এক ব্যক্তির চোখে পড়ে দুটি শিশু কান্না করছে। কিন্তু সঙ্গে তাদের অভিভাবক
নেই। পরে ওই ব্যক্তি সাজেদা ও মল্লিকাকে ট্র্রেন থেকে নামিয়ে দত্তপাড়ায় একটি মাতৃসদনে নিয়ে যান। সেখানে তাদের ভর্তি করে দেন।
এরপর ১৯৮০ সালের দিকে নেদারল্যান্ডস থকে এভার্ট বেকার ও মেরিয়ান্ট রেজল্যান্ড নামের এক নিঃসন্তান দম্পতি বাংলাদেশে আসেন। তারা টঙ্গীর ওই মাতৃসদন থেকে শিশু মল্লিকাকে দত্তক নেন। এর কিছুদিন পরে ওই দম্পতির মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসের আরেকটি পরিবার মল্লিকার ছোট বোন সাজেদাকেও দত্তক নেন। সেখানেই সাজেদা ও মল্লিকা বড় হয়। পরিবারের কাছে তাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ জানতে পারলেও প্রকৃত আত্মপরিচয় জানতে পারেননি তারা।
এরমধ্যে সাজেদা ও মল্লিকা একাধিকবার বাংলাদেশ ঘুরে গেলেও স্বজনের খোঁজ পাননি। এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তেও একটি প্রতিবেদন প্রচার হয়। এর সূত্র ধরে অনেকেই তাদের হারিয়ে যাওয়া সন্তানের জন্য বিভিন্ন মিডিয়া ও ইত্যাদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এর মধ্যে গফরগাঁও থেকে সাজেদা ও মল্লিকার স্বজনরাও যোগাযোগ করেন। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে সাজেদা ও মল্লিকার আসল পরিচয় মেলে। মল্লিকার ভাই ছুতু মিয়া (৫৫) ও বোন ছুলেমান নেছারের (৬০) ডিএনএ রিপোর্ট নেদারল্যান্ডসে পাঠানোর পর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিশ্চিত হয় তাদের পরিচয়।
মল্লিকা স্বামী ও দুই মেয়েকে নিয়ে খারুয়া মুকুন্দ গ্রামের বাড়িতে। ছবি: সংগৃহীত
১৬ জুলাই, সোমবার বিকেলে ইত্যাদির একটি টিমের সঙ্গে মল্লিকার স্বামী থমাস ও দুই কন্যাসন্তানকে নিয়ে খারুয়া মুকুন্দ গ্রামের বাড়িতে যান। সেখানে ভাইবোন ও স্বজনের সঙ্গে দেখা করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তারা। পরে বাবা-মার কবর জিয়ারত করেন। এ সময় পুরো বাড়িতে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
এ সময় ভাঙা ভাঙা বাংলায় আনোয়ারা ওরফে মল্লিকা বলেন, ‘মা-বাবার জন্য খারাপ লাগছে। তবে ৪০ বছর পর আমি আমার শিকড়ের সন্ধান পেয়েছি। অনেক খুশি আমি।’
ছুলেমান নেছার হারিয়ে যাওয়া বোনকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘৪০ বছর পর বোন ফিইরা আইছে। এত দিন ভাবছিলাম বোনডা মইরা গেছে। ওরে পাইয়া এখন কইলজাডা ঠান্ডা অইয়া গেছে।’
ভাই ছুতু মিয়া বলেন, ‘বোনকে খোঁজে পেয়ে আমরাও অনেক খুশি।’
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সাহাবুল আলম জানান, বিষয়টি খুবই আবেগের। সিনেমায় দেখা যায় হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে বহু বছর পর ফিরে পেতে। কিন্তু বাস্তবে এমন ঘটনা ঘটবে ভাবতেও পারেননি তিনি।