মালয়েশিয়ায় প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি। ২০১৬ সাল থেকে অবৈধ প্রবাসীদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দেয় মালয়েশিয়া। ধাপে-ধাপে সময় বাড়িয়ে দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে চলে এই বৈধকরণ প্রক্রিয়া। শেষ হয় চলতি বছরের ৩০ জুন। কিন্তু এই আড়াই বছরে দেশটিতে বৈধ হওয়ার সুযোগ নিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত প্রতারকদের ফাঁদে পড়েছেন অসহায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
বৈধ করে দেওয়ার নামে অবৈধ কর্মীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়েছে অনেক প্রতারকচক্র। বৈধ হওয়ার জন্য প্রতারকদের হাতে টাকা-পয়সা ও পাসপোর্ট তুলে দিয়েও কপালে জোটেনি বৈধতা। মালয়েশিয়ায় এমন অবৈধ প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা ৫০ হাজারেরও বেশি। তাঁরা বর্তমানে ইমিগ্রেশন এবং পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
জানা গেছে, মালয়েশিয়া সরকার অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার জন্য দু’টি প্রোগ্রাম চালু রেখেছিলো। এর একটি রি-হায়ারিং প্রোগ্রাম, অন্যটি ই-কার্ড। এই দু’টি প্রোগ্রামকে ঘিরে দেশটিতে গড়ে ওঠে শক্তিশালী একাধিক প্রতারকচক্র। বৈধ হওয়া এবং কাজ পাওয়ার জন্য এই চক্রকে টাকা দিয়ে টিকে থাকতে হয় বাংলাদেশি কর্মীদের। বৈধ করে দেওয়ার নামে জনপ্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার রিংগিত হাতিয়ে নিয়েছে চক্রগুলো।
মালয়েশিয়া প্রবাসী শ্রমিক আশরাফ উদ্দিন বলেন, ১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি প্রতারকচক্র দেশটিতে কর্মী কিনছে এবং বিক্রি করছে। প্রতারকরা কখনো হাই-কমিশনের নামে, কখনো পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করে দেওয়ার নামে, কখনো বৈধ করে দেওয়ার কথা বলে কর্মীদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায় করছে। তিনি বলেন, প্রবাসী শ্রমিকেরা কোনোভাবেই মুক্তি পাচ্ছেন না প্রতারকচক্রের হাত থেকে। বরং বাধ্য হচ্ছেন এই চক্রের কথামতো চলতে।
মালয়েশিয়ায় বৈধতার আবেদনের জন্য প্রত্যেক অবৈধ কর্মীকে সরকারিভাবে ১২ শ’ রিংগিত জমা দিতে হতো। কিন্তু প্রতারকচক্রের ফাঁদে পড়ে অনেক বাংলাদেশি বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়েও বৈধ হওয়ার সুযোগ পাননি।
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের একটি কারখানায় কাজ করেন রংপুরের মিঠাপুকুর থানার আজমাল হোসেন। ২০১৩ সালের কলিং ভিসায় মালয়েশিয়ায় যান তিনি। ভিসার মেয়াদ শেষে বর্তমানে অবৈধভাবে বসবাস করছেন। আজমাল হোসেন বৈধতার জন্য যোগাযোগ করেন শরীয়তপুরের আক্তার মোল্লার সংগে। আক্তারও দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ায় বাস করেন।
নিজের বৈধ হওয়ার বিষয়ে আজমাল হোসেন বলেন, রি-হায়ারিং করে দেওয়ার নামে আক্তার তাঁর কাছ থেকে দু’দফায় ২০ হাজার রিংগিত নিয়েছেন। আজমাল হোসেন অভিযোগ করেন, এতো টাকা নিয়েও আক্তার মোল্লা তাঁকে বৈধতার কোনো কাগজ দিতে পারেনি। বর্তমানে তিনি অবৈধ হয়ে দেশটিতে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, এখন বৈধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ চড়াসুদে ঋণ করে মালয়েশিয়ায় গেছেন তিনি। এই অবস্থায় কোনোভাবেই দেশে ফেরাও সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
এদিকে, মালয়েশিয়া সরকার পহেলা জুলাই থেকে মেগা-থ্রি নামে অভিযান শুরু করেছে। যেখানেই অভিযান পরিচালিত হচ্ছে, সেখানেই আটক হচ্ছেন অবৈধরা। আটকের পর অবৈধদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে এবং তাঁদের অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, ইন্ডিয়ান ও মালয়েশিয়ান প্রায় ১শ’ জন প্রতারক এজেন্টের তালিকা তৈরি করেছে মালয় অভিবাসন বিভাগ। মেগা-থ্রি অভিযানের পাশাপাশি এসব প্রতারককে ধরতে গোপনে কাজ করছে দেশটির স্পেশাল বিভাগ। এমনকি মালয়েশিয়ায় মানবপাচারের সংগে জড়িত দালাল থেকে শুরু করে পুরো সিন্ডিকেট ধরতে মাঠে নেমেছে ইমিগ্রেশন বিভাগ।
গত ১০ জুলাই বাংলাদেশি দালাল চক্রের একটি অফিস থেকে ৬৬ জনকে উদ্ধার করেছে ইমিগ্রেশনের স্পেশাল ব্রাঞ্চ। এ সময় অফিসটিতে কর্মরত ১১ জন বাংলাদেশি ও দু’জন মালয়েশিয়ান নাগরিককেও গ্রেফতার করা হয়।
ইমিগ্রেশন বিভাগের মহাপরিচালক দাতুক সেরি মোস্তাফার আলী জানান, দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়াকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে অবৈধ শ্রমিক আমদানি করে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন কলকারখানায় সাপ্লাই করতো সিন্ডিকেট গ্রুপটি। তিনি জানান, বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধভাবে শ্রমিক এনে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে মালয়েশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাপ্লাই করা হতো। আটকদের অভিবাসন আইন ১৯৫৯/৬৩, ১৯৬৬, ১৬৩ অনুযায়ী গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ায় অনেক বিদেশি বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় কাজ করছেন। কর্মরত বিদেশি কর্মীদের ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ ইন্দোনেশিয়ার, ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ নেপালের, ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ বাংলাদেশের, ৬ দশমিক ৯ শতাংশ, মায়ানমারের, ৫ দশমিক ১ শতাংশ ভারতের, ৩ দশমিক ১ শতাংশ ফিলিপাইনের, ২ দশমিক ৫ শতাংশ পাকিস্তানের, শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ থাইল্যান্ডের এবং ৪ দশমিক অন্য দেশের।
তথ্যসূত্র: ভয়েস বাংলা