ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যখন গোয়েন্দা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র ভূমিতে এ এক বিস্ময়কর উদ্ভাবন। আবিষ্কারক আর কেউ নন। স্বয়ং ভিসি প্রফেসর আখতারুজ্জামান। চাঞ্চল্য তৈরি করেছেন তিনি। তার আবিষ্কারে লা জবাব সবাই। মাসুদ রানা কোন ছার! যেন তিনিই সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা।
সময় কত কিছুই না বদলে দেয়। তাই বলে এতোটা। তিন মাস আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন প্রফেসর আখতারুজ্জামান। বলেছিলেন, যৌক্তিক দাবির সঙ্গে ঢাবি প্রশাসন একমত। আর রোববার তিনি যে আবিষ্কারের কথা জানালেন, তা অবিশ্বাস্য। তবে অবিশ্বাস, বিস্ময় কাটিয়ে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো- ঢাবি ভিসি কাকে ডোবালেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস মোটাদাগে দু’ভাগে বিভক্ত। একটি জাতি-রাষ্ট্রের জন্মে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা দুনিয়ার আর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেই। যদিও সাম্প্রতিককালে শিক্ষা-গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছু হটা নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে রোববার নতুন এক তত্ত্ব দিয়ে অতীতের সব দুর্নামের রেকর্ড যেন অতিক্রম করে ফেললেন আখতারুজ্জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভয়ঙ্কর এক বদনাম ডেকে আনলেন তিনি। কোটা সংস্কারের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তালেবান, শাবাব, বোকো হারাম, লাদেন, মোল্লা ওমরের কার্যক্রমের মিল দেখতে পান তিনি। অকপটে সাংবাদিকদের আবার সে কথা বললেনও। এ নিয়ে চারদিকে ছি ছি! রব উঠলেও তার যেন কিছু যায়-আসে না।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সাম্প্রতিককালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কপালে এতো বড় কলঙ্ক তিলক আর কেউ আঁকতে পারেননি। নিজ প্রতিষ্ঠানকে ডোবানোর এ কৃতিত্ব তাকে দিতেই হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ পর্যবেক্ষকদের বিপুল দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। সমাজে, রাষ্ট্রে নারীর অগ্রগতির চিহ্ন হিসেবেই একে দেখতে পেয়েছেন তারা। অথচ এখানেও জঙ্গিবাদের ভূত দেখছেন আখতারুজ্জামান। গুলশান হামলার পর বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ইস্যুটি নতুন করে বড় রকমের আলোচনায় আসে। বাংলাদেশ সরকার বরাবরই এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতির অনুসরণ করে আসছে। জঙ্গিবাদী কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আলোচনায় এলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম কখনো এ তালিকায় আসেনি। সে তালিকায় নিজের প্রতিষ্ঠানের নাম যুক্ত করতে কী আপ্রাণ চেষ্টাই না করছেন ঢাবি ভিসি।
প্রফেসর আখতারুজ্জামানের আলোচিত এ বক্তব্যের ঘণ্টা দুয়েক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ ক্যাম্পাসে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করে। যেখানে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানানো হয়। সমর্থন জানানো হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনে। সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ওই কর্মসূচিতে অংশ নেন। তিনি ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনাকে লজ্জাজনক এবং দুঃখজনক হিসেবে অভিহিত করেন। এটাও বলেন যে, বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। আমাদের কপাল ভালো যে, ওই শিক্ষকদের এখনো পর্যন্ত জঙ্গি বলেননি আখতারুজ্জামান। হয়তো বলতেও পারেন।

প্রয়াত লেখক আহমদ ছফার বিখ্যাত উপন্যাস গাভী বিত্তান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, তার বাসার গাভীকে ঘিরে কীভাবে পরিচালিত হয় নষ্ট শিক্ষক রাজনীতি তার ছবি এঁকেছেন মহাত্মা ছফা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আখতারুজ্জামানের জঙ্গি তত্ত্ব প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় এসেছে সেই গাভীটি। অনেকেই বলছেন, আহমদ ছফা এখন বেঁচে থাকলে কী লিখতেন?

জঙ্গিবাদ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আলী রীয়াজ। আখতারুজ্জামানের বক্তব্যে বিস্মিত আলী রীয়াজ এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কোটা সংস্কার আন্দোলনের কর্মীদের ‘জঙ্গি’ বলে বর্ণনার সময় তাদের তুলনা করেছেন তালেবান, আল শাবাব এবং বোকো হারামের সঙ্গে। তিনি বলেছেন যে, তিনি ফেসবুক ব্যবহার করেন না, কিন্তু তার একজন সহকর্মী তাকে এমন কোনো ভিডিও দেখিয়েছেন যা থেকে তার এই উপসংহার। আমি দীর্ঘদিন ধরে উগ্র সহিংসবাদ এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিষয়ে পঠন-পাঠনের চেষ্টা করছি; বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নিয়ে সামান্য গবেষণার অভিজ্ঞতাও আছে; সেই আগ্রহ থেকে এবং আমার গবেষণার প্রয়োজনেই আমি জানতে চাইছি- সেই ভিডিওটা কোথায়? তা ছাড়া উপাচার্য যেহেতু দেখেছেন সেহেতু এটা কোথাও আছে; সেটা দেখার অধিকার বাংলাদেশের মানুষের নিশ্চয় আছে। যদি এটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে চান সেইভাবে বিবেচনা করেই উপাচার্য মহোদয় বলুন কোথায় সেই ভিডিও?”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামও ভিসি আখতারুজ্জামানের যুক্তি মেনে নিতে পারেননি। তিনি বলেছেন, ‘সমস্ত পৃথিবীতে তরুণরা যার মাধ্যমে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করছে সেটি হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সেটি জঙ্গিরা ব্যবহার করে আর এরা ব্যবহার করছে বলেই জঙ্গি হয়ে গেল এই যুক্তি আমি মেনে নিতে কোনো দিনই পারবো না। আমি এদের অনেককেই চিনি। এরা আমাদেরই সন্তান। তাদের প্রতি আমাদের বিশ্বাস থাকা উচিত, তাদেরকে আমাদের সম্মান করা উচিত।’

ইতিহাস নানা ধরনের শিক্ষক দেখেছে। কেউ নিজ ছাত্রদের রক্ষা করতে বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছেন। আর কেউ ক্ষমতাসীনদের তোষামোদির রেকর্ড গড়েছেন। প্রফেসর আখতারুজ্জামানকে ইতিহাস কীভাবে মনে রাখবে সে বিচার ইতিহাসের।