বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইউরোপীয়রা ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাচ্ছেন কেন?

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাপক হারে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা এবং থিতু হচ্ছেন। ফলে তাঁদের প্রবাস জীবন থেকে “বাংলাদেশি” ট্যাগলাইনটি অফিসিয়ালি হারিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের লন্ডন-অভিবাসনের পেছনে ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক মন্দা, কর্মসংস্থান হ্রাসের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণও রয়েছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি কমিউনিটি ছোট ও প্রায় বিভাজিত বলে অসংগঠিত ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেশীয় সংস্কৃতির আবহ থেকেও তাঁরা বিচ্ছিন্ন। ইউরোপের এসব দেশে জীবন-যাপন পদ্ধতি ও নিরাপত্তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান ও ধর্মীয় আচারাদি পালনের সুযোগ সীমিত বা কোথাও একেবারে সুযোগ না থাকায় তাঁরা ইংল্যান্ডমুখী হচ্ছেন। অনেক দেশে ইংরেজি ভাষায় আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষালাভের কম সুযোগ থাকাও ইংল্যান্ডমুখী অভিবাসনের অন্যতম কারণ।

অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যে একটি সুবৃহৎ বাংলাদেশি কমিউনিটির কথা সর্বজনবিদিত। লন্ডনের পূর্বপ্রান্তে গড়ে ওঠা বাঙালি পাড়া তো বাংলা টাউন নামেই খ্যাত। স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শক্তিশালী অব্স্থানে রয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা। বৃহৎ কমিউনিটির কারণে বাঙালি সংস্কৃতি, ধর্মীয় চর্চা, ধর্মীয় শিক্ষালাভ এবং স্বদেশি আবহে সন্তানদের লালন-পালন করা ও সবাই মিলেমিশে থাকার সুযোগ এখানে অবারিত। এ কারণেই ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইউরোপীয়রা। ইতিমধ্যে অনেকে ইংল্যান্ডে এসে থিতুও হয়েছেন।

ইংল্যান্ডে আসার আরেকটি বড় কারণ হলো- এখানে এসেই সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন তাঁরা। এছাড়া চাকরি ও ব্যবসার জন্যও অনুকূল পরিবেশ রয়েছে এখানে।

জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে পঞ্চাশ হাজারের বেশি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইউরোপীয় এসেছেন ইংল্যান্ডে। এর মধ্যে শুধু ইতালি থেকেই এসেছেন কমপক্ষে ত্রিশ হাজার জন।

পক্ষান্তরে, ইংল্যান্ডের অভিবাসন আইনে বারবার পরিবর্তন, নানান শর্তারোপ ও কড়াকড়ির কারণে একই সময়ে বাংলাদেশ থেকে এদেশে অভিবাসনের গতিও অনেক শ্লথ হয়েছে। এছাড়া ভিসা জটিলতায় বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ইংল্যান্ড ছেড়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বসবাসের জন্য পাড়ি জমিয়েছেন ফ্রান্স, স্পেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। তাঁদের অনেকেই ফিরছেন ইংল্যান্ডে।

এ কারণেই ‘তৃতীয় বাংলা’খ্যাত ইংল্যান্ডে গত পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্যা হারে বাড়ছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতের সংখ্যা।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বেশক’জন বাংলাদেশির সংগে কথা বলে জানা যায়, ইউরোপের দেশগুলোতে ইংরেজি ভাষার চর্চা কম। আবার একেক প্রদেশে একেক ভাষা, শিক্ষার মাধ্যমও সে দেশের ভাষা। এসব কারণে সেসব দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সন্তানদের লেখাপড়া ও উচ্চশিক্ষায় ব্যাঘাত ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে ওই শিক্ষার উপযোগিতাও যুক্তরাজ্যের তুলনায় কম। এছাড়া, জার্মানি, অস্ট্রিয়ার মতো ইউরোপের বহু দেশে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়েও মেলে না একটি মসজিদ। অনেক দেশে বাংলাদেশি কমিউনিটি নেই বললেই চলে। শত মাইলের মধ্যেও পাওয়া যায় না কোনো বাংলাদেশি পরিবার। এর সংগে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা। এসব কারণে সবাই পাড়ি দিচ্ছেন ইংল্যান্ডে। তাঁদের মতে, যুক্তরাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানের। লন্ডনের প্রায় প্রতিটি সড়কে মসজিদ থাকায় সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের সুবিধা রয়েছে। বিশাল বাংলাদেশি কমিউনিটি থাকায় সন্তানদের বাঙালি সংস্কৃতি বলয়ের মধ্যে গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে। নিজেরাও পাচ্ছেন স্বদেশি সামাজিকতার স্বাদ।

যুক্তরাজ্যের অভিবাসন সংক্রান্ত একাধিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে নেমে এসেছে স্থবিরতা। ইতালি, পর্তুগাল, স্পেনসহ ইউরোপের দেশগুলোতে বেকারত্ব বাড়ছে। বাংলাদেশিরা কাজ হারাচ্ছেন বা পছন্দের কাজ পাচ্ছেন না। এ প্রেক্ষাপটে ইউরোপের অন্য দেশগুলোর তুলনায় সার্বিকভাবে অনেক ভালো অর্থনৈতিক অবস্থায় রয়েছে যুক্তরাজ্য।

গত কয়েক বছর ধরে ইউরোপ থেকে ইংল্যান্ডে অভিবাসনের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় শংকা প্রকাশ করেছেন ব্রিটিশ সরকারের শীর্ষ নীতি-নির্ধারকরাও। কেননা, কেবল ২০১০ সালেই ইউরোপ থেকে যুক্তরাজ্যে এসেছেন পাঁচ লাখ ৯১ হাজার মানুষ। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসেছেন দুই লাখ ২৯ হাজার। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইউরোপীয়।