গৃহকর্ত্রী বলে কথা! সামান্য এক কাজের মহিলা কেন কথা শুনবে না? গৃহপরিচারিকার সঙ্গে এমন আচারণ বোধহয় ঘরে ঘরে। এরকম এক গৃহকর্ত্রীর আমানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের ইটাপোতা গ্রামের স্বামী পরিত্যাক্তা মাজেদা বেগম(৩৬)। গৃহকর্ত্রী কারণে অকারণে শরীরের বিভিন্ন স্থানে এবং যৌনাঙ্গে খুন্তির ছ্যাকা দিতেন। এখানেই শেষ নয় ক্ষতস্থানে মরিচের গুঁড়া লেগে দিতেন। নির্যাতিতা গৃহকর্তার সহযোগিতায় বাসা থেকে পালিয়ে এখন লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন।
সোমবার (২৫ জুন) রাতে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় মাজেদা বেগমকে। তিনি মোগলহাট ইউনিয়নের ইটাপোতা গ্রামের কলিম উদ্দিনের মেয়ে।
পুলিশ, চিকিৎসক ও নির্যাতিত গৃহপরিচারিকা জানান, গত তিন মাস আগে লালমনিরহাট সদর উপজেলা সমাজ সেবা অফিসের ইউনিয়ন সুপারভাইজার মঞ্জুরা বেগম নিজের বাসার গৃহপরিচারিকা জন্য মাজেদা বেগমকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসেন। এরপর মঞ্জুরা তাকে নিজের বাসায় না রেখে, ভাগিনী মৌসুমি বেগমের ঢাকাস্থ রামপুরার বাসায় পাঠান। মৌসুমী নিজে গৃহিনী হলেও তার স্বামী হাবিবুর রহমান একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট হিসেবে রামপুরা এলাকায় কর্মরত।
মাজেদা বেগম জানান, ওই বাসায় যাওয়ার পর থেকেই কারণে অকারণে গৃহকর্ত্রী মৌসুমী প্রায় মারপিট করত। পাথর দিয়ে তার মুখের নিচের পাটির সামনের দাঁতগুলো ভেঙে দেয়। গরম তেলের খুন্তি দিয়ে গোপনাঙ্গ বুকে, পিঠেসহ পুরো শরীরে ছ্যাকা দেন। ছ্যাকার আঘাতে শরীরের বিভিন্ন স্থানে পচে দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে। এতেই শেষ নয় কাচা মরিচের গুঁড়া গোপানঙ্গসহ পুরো শরীরের ক্ষত স্থানে মেখে দেয় মৌসুমী। এতে আহত মাজেদা চিৎকার চেচামেচি করার চেষ্টা করলে বা তার স্বামী পুলিশ সার্জেন্টকে জানালে জবাই করে মেরে ফেলারও হুমকি দেন। বিষয়টি গৃহকর্তা পুলিশ সার্জন হাবিবুর জানতে পেয়ে স্ত্রীকে শাসন করতে গেলে উল্টো হাবিবুরকে মারপিট করে তার স্ত্রী মৌসুমি।
স্ত্রীকে শাসন করতে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ সার্জেন্ট হাবিবুর গত শনিবার(২৪ জুন) রাতে গোপনে মাজেদাকে বাসা থেকে বের করে নিয়ে লালমনিরহাটের একটি বাসে উঠায়ে দেন এবং তার খালা শ্বাশুরি মঞ্জুরা বেগমকে ফোনে জানান। পরদিন রবিবার সকালে মঞ্জুরা বেগম অসুস্থ্য মাজেদাকে বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে হাসপাতালে না নিয়ে তার বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেন।
অসুস্থ মাজেদা বাড়ি পৌঁছলে প্রতিবেশিরা পরের দিন সোমবার রাতে তাকে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। বর্তমানে হাসপাতালের তৃতীয় তলার ৫৪ নং বেডে সেখানে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন গৃহপরিচারিকা মাজেদা বেগম। অর্থের অভাবে অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসা করাতে পারছেন না মাজেদার বৃদ্ধ বাবা কলিম উদ্দিন। স্থানীয়দের খবরে মঙ্গলবার দুপুরে সদর থানা পুলিশ হাসপাতালে গিয়ে নির্যাতিতা মাজেদার অভিযোগ শুনেন এবং তার চিকিৎসার খোঁজ খবর নেন।
কলিম উদ্দিন জানান, অসুস্থ শরীরে কাজে অক্ষম হওয়ায় স্থানীয় ও সরকারের সাহায্যে স্ত্রী ও মাজেদার দুই ছেলের মুখে এক বেলা ভাত দিতে হিমসিম খাচ্ছেন। সেখানে আবার মাজেদার চিকিৎসা করা তার পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব। তবে মেয়ের উপর নির্যাতনের বিচার চান তিনি।
অভিযুক্ত গৃহকর্ত্রী মৌসুমীর খালা লালমনিরহাট সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসের ইউনিয়ন সুপারভাইজার মঞ্জুরা বেগম জানান, তার ভাগনী মৌসুমী এমন নির্যাতন করে ঠিক করেনি। তার বিচার হওয়া উচিৎ। তবে অফিসে কাজের ব্যস্ততায় হাসপাতালে মাজেদার চিকিৎসার খোঁজ-খবর নিতে পারেনি বলে দাবি করেন তিনি।
নির্যাতিতা মাজেদাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা প্রতিবেশি মর্জিনা বেগম জানান, ‘মাজেদার আত্মচিৎকারে নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। তাই নিজ উদ্যোগে মাজেদাকে হাসপাতালে নিয়ে এসে ভর্তি এবং ওষুধপত্র কিনে দেই।’
লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মঞ্জুর মোর্শেদ জানান, ‘মাজেদার পুরো শরীরের আগুনের ছ্যাকার চিহ্ন রয়েছে। সামনের পাটির দাঁতগুলো নেই। তাকে নিবির পরিচর্যায় চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সুস্থ্য হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে।’
লালমনিরহাট সদর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজ আলম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, ‘নির্যাতিত মাজেদার চিকিৎসার খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত থানায় কেউ অভিযোগ করেনি। তারপরেও লোক মুখে শুনে হাসপাতালে নির্যাতিতা মাজেদাকে দেখার ও ঘটনা জানার জন্য অফিসার পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।