বর্জ্যের বিষে নীল হালদার পানি

তৌকির আহমেদ পরিচালিত ‘হালদা’ চলচ্চিত্রের এ গানে শিল্পী পিন্টু ঘোষ ও নন্দিতা জীবনের যে জয়গান গেয়েছেন তা আজ যেন থমকে যেতে বসেছে। শিল্প ও আবাসিক বর্জ্যের দূষণে মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় কার্প জাতীয় মাছের অন্যতম প্রজননকেন্দ্র চট্টগ্রামের হালদা নদী। দূষণের কারণে কয়েক বছর ধরে হালদায় কমেছে মাছের রেণু উৎপাদন। গত দশদিন ধরে হালদার বিভিন্ন অংশে ভাসছে মরা মাছ। দেখার যেন কেউ নেই!

হালদার বিপর্যয় শুরুর পর এর কারণ অনুসন্ধানে গবেষণা চালায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরি ও পরিবেশ অধিদফতরের একটি যৌথ দল। এতে দেখা যায়, নদীর পানিতে মাত্রাতিরিক্ত অ্যামোনিয়ার উপস্থিতির জেরে হালদায় মারা যাচ্ছে মাছ। গবেষণায় জানা গেছে, অ্যামোনিয়া বৃদ্ধির কারণে বাড়ছে নদীর দূষণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হালদা দূষণের এ ধারা অব্যাহত থাকলে তার প্রভাব পড়বে আশপাশের জনজীবনেও।

হালদা বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া জানান, হালদার যেসব স্পটে মাছ মারা যাচ্ছে সেসব স্থানে পানি পরীক্ষা করে দশমিক তিন থেকে দশমিক ছয় পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) অ্যামোনিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। যদিও পানিতে এর সহনশীল মাত্রা ০.০২ পিপিএম। সেখানকার পানিতে পাওয়া গেছে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ১৪ থেকে ২৮ গুণ বেশি অ্যামোনিয়া। যা মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ের বন্যায় বিভিন্ন খালের পানি হালদায় এসে পড়েছে। ওই সব খালের অধিকাংশই আবাসিক, শিল্প ও ট্যানারির বর্জ্যে ভরা। ফলে পানিতে বেড়েছে অ্যামোনিয়ার উপস্থিতি, কমেছে অক্সিজেন। যা হালদার মা মাছসহ সব ধরনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের অন্যতম কারণ।’

‘দূষণের মাত্রা এভাবে বাড়তে থাকলে হালদার পরিণতি বুড়িগঙ্গার মতো হবে। দূষণের কারণে হালদার পাশাপাশি বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষিজমিও অনাবাদি হয়ে পড়ছে। তাই এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।’

হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য ও মাছের প্রজনন নিয়ে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অন্তত ১০টি কারণে প্রতিদিন দূষণের কবলে পড়ছে দক্ষিণ এশিয়ায় কার্প জাতীয় মাছের অন্যতম প্রজননকেন্দ্র হালদা। এর মধ্যে রয়েছে, আবাসিক, শিল্প ও ট্যানারির বর্জ্যে প্রতিনিয়ত দূষণ, নদী থেকে নির্বিচারে বালু উত্তোলন, নদীর তীরে একের পর এক গড়ে ওঠা ইটভাটায় নদীর মাটি ও পানির ব্যবহার, ফটিকছড়ির চা-বাগানগুলোর জন্য নদীর পানি ব্যবহার, নদীতে রাবার ড্যামের (বাঁধ) প্রতিবন্ধকতা, নদীর অন্তত ১১টি স্থানের বাঁক সমান করে ফেলা, নদীর তীরে তামাক চাষ ও যন্ত্রচালিত নৌযান থেকে তেলের নিঃসরণ।

এর আগে চলতি বছরের এপ্রিলে হালদায় গাঙ্গেয় প্রজাতির বিপন্ন ডলফিনের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে নদীর পানিতে মাত্রাতিরিক্ত অ্যামোনিয়ার উপস্থিতি পায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট।

সূত্র জানায়, হালদা পাড়ের শিল্পকারখানাগুলোর বেশির ভাগেরই ইটিপি (তরল বর্জ্য শোধনাগার) নেই। যেসব কারখানার ইটিপি রয়েছে, সেগুলোও সব সময় চালু করা হয় না। তাই কারখানা ও ট্যানারির দূষিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ছে।

হাটহাজারীর খন্দকিয়া, কাটাখালী, বাথুয়া, কৃষ্ণখালী, শাহ মাদারী ও চট্টগ্রাম নগরের বামনশাহী খাল বেয়ে বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও গৃহস্থালির বর্জ্য সরাসরি পড়ছে হালদায়। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চলমান অন্যান্য আবাসিক এলাকার মাস্টার ড্রেনটি বামনশাহী খালের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ফলে বামনশাহী ও হাটহাজারীর কুয়াইশ খালের মাধ্যমে নগর ও হাটহাজারীর বিশাল এলাকার বর্জ্য হালদায় গিয়ে মিশছে।

শিল্পবর্জ্যের জন্য স্থানীয়রা দায়ী করছেন নগরের মদিনা ট্যানারি, রওশন ট্যানারি ও রিফ লেদার, হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট, কেডিএস ডায়িং ও টিকে ডায়িং, ইব্রাহিম কটন মিল এবং এশিয়ান পেপার মিলের মতো প্রতিষ্ঠানকে। এসব প্রতিষ্ঠানের তরল বর্জ্য বিভিন্ন খাল হয়ে হালদায় পড়ছে। এছাড়া চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অন্যান্য আবাসিক এলাকার বর্জ্য প্রকল্পের মূল নালা হয়ে কুয়াইশ, কৃষ্ণখালী ও খন্দকিয়া খাল দিয়ে পড়ছে হালদায়।

স্থানীয় বাসিন্দা ও সচেতন নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম মুন্না জাগো নিউজকে বলেন, ‘নগরীর বায়েজিদ, কুলগাঁও থেকে নন্দীর হাট পর্যন্ত সব কারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে হালদার বিভিন্ন শাখা খালে। ফলে খালের পানি গাঢ় নীল রং ধারণ করেছে। এসব বর্জ্য খাল বেয়ে পড়ছে হালদায়। দূষিত হচ্ছে হালদা, নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। মরছে মাছ।’

সরেজমিন গত শনিবার (২৩ জুন) ফতেয়াবাদের খইজ্জা ছড়ার জেলেপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বর্জ্যমিশ্রিত খালের গাঢ় নীল পানি এবং এর দুর্গন্ধে যে কারও বমি হতে পারে। তরল বর্জ্যের পাশাপাশি পানিতে ভাসছে প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিনসহ গৃহস্থালির বর্জ্য। উত্তর মাদার্শা এলাকায় শাহ মাদারি খালের চিত্রও একই। এমন হাজার হাজার টন বর্জ্য বিভিন্ন খাল বেয়ে হালদার পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।

হাটহাজারীর উত্তর ফতেয়াবাদ এলাকার কৃষক জসিম উদ্দিন বলেন, ‘নন্দীর হাটের এশিয়া প্যাসিফিক পেপার মিলস লিমিটেড ও জননী পেপার মিলস কারখানার সব বর্জ্য শাহ মাদারি খাল বেয়ে সরাসরি হালদায় মিশছে। এছাড়া হাটহাজারী সদরের হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের বর্জ্য চেঙখালি খাল হয়ে মিশছে হালদায়। নদীতে মিশে যাওয়ার আগে স্থানীয় খাল দিয়ে এসব বর্জ্য প্রবাহিত হয়, যা খুবই দুর্গন্ধযুক্ত। একসময় এসব খালে মাছ পাওয়া যেত, কিন্তু এখন আর পাওয়া যায় না। বর্জ্য মিশে পানি এতই বিষাক্ত হয়েছে যে, হাঁস-মুরগি এসব খালে নামলেই মারা যায়। জমিতে খালের পানি ব্যবহার করা যায় না। এ কারণে জমির উৎপাদন ক্ষমতা অনেক কমে গেছে।’

মৎস্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক প্রভাতী দেব এ বিষয়ে জাগো নিউজকে বলেন, ‘নদীর পাড়ে অবস্থিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কর্ণফুলীর দূষণের প্রভাব পড়ছে হালদায়। জোয়ারের মাধ্যমে কর্ণফুলীর দূষিত পানি হালদায় ঢুকছে। সাম্প্রতিক সময়ে কর্ণফুলীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ তিনের নিচে পাওয়া গেছে। পানিতে থাকা যে কোনো জীবের জন্য এমন পরিস্থিতি অত্যন্ত ক্ষতিকর।’

চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিক জানান, দ্রবীভূত অক্সিজেন ৪ দশমিক ৫-এর নিচে নামলে তাতে জলজ প্রাণী বাঁচে না। অন্যদিকে বিওডি (বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড) ৬-এর কম থাকা জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর।

‘২০১৭ সালের এক গবেষণায় হালদাসংলগ্ন বিভিন্ন খালের পানি পরীক্ষা করে দূষণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত জুলাই মাসে ঘোর বর্ষাকালে খন্দকিয়া খালের পানিতে ডিও (দ্রবীভূত অক্সিজেন) পাওয়া গেছে প্রতি লিটারে ২ দশমিক ২৯ মিলিগ্রাম। দূষণের দায়ে মদিনা ট্যানারি, এশিয়ান পেপার মিল, রীফ লেদার লিমিটেডসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময়ে জরিমানা করে পরিবেশ অধিদফতর। অধিদফতরের নির্দেশে মদিনা ট্যানারি ও রীফ লেদার বর্তমানে বন্ধ রয়েছে’ বলেও জানান তিনি।