পথচারীকে মেরে পালিয়ে যাওয়া গাড়ির চালক সাংসদের ছেলে?

ঈদ-পরবর্তী ঢাকার ফাঁকা রাস্তায় গত মঙ্গলবার রাতে এক পথচারীকে মেরে পালিয়ে গিয়েছিল গাড়িটি। তবে গাড়ির নম্বরপ্লেটটি রাস্তায় পড়ে যায়। গাড়ির ধাক্কায় খুলি ফেটে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া হতভাগ্যের দেহটি তুলতে গিয়ে পাওয়া যায় নম্বরপ্লেটটি। সেই নম্বরের সূত্র ধরে জানা গেল, গাড়িটির মালিক নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার চেয়ারম্যান কামরুন্নাহার শিউলি। তাঁর স্বামী একরামুল করিম চৌধুরী নোয়াখালী-৪ আসনের সাংসদ।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, গাড়িটি চালাচ্ছিলেন সাংসদের ছেলে শাবাব চৌধুরী। দুর্ঘটনার পর পথচলতি এক মোটরসাইকেলচালক গাড়িটির পিছু নিয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর ন্যাম ফ্ল্যাট (সাংসদদের আবাসিক এলাকা) পর্যন্ত পৌঁছান। সেখানে তরুণ গাড়িচালক নিজেকে সাংসদের ছেলে দাবি করে ওই মোটরসাইকেলচালককে মারধর করেন। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলকে দেওয়া ওই মোটরসাইকেলচালকের সাক্ষাৎকারটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

তবে গাড়ির মালিক কামরুন্নাহার শিউলি দাবি করেছেন, তখন গাড়িটি তাঁর ছেলে চালাচ্ছিলেন না। চালাচ্ছিলেন গাড়িচালক নুরুল আলম। আলম গাড়ি নিয়ে উত্তরায় তাঁদের এক স্বজনের কাছে যাচ্ছিলেন। ফেরার পথে দুর্ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে আলমকে পাওয়া যাচ্ছে না।

অবশ্য পুলিশ এখনো গাড়িটি আটক করেনি। গাড়িটি কে চালাচ্ছিলেন, তা শনাক্ত করতেও পুলিশের দৃশ্যমান তৎপরতা নেই।

কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শিকদার মো. শামীম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় নিহত ব্যক্তির জামাতা অজ্ঞাতনামা চালককে আসামি করে মামলা করেছেন। গাড়িটির নম্বরপ্লেট তাঁরা বিআরটিএতে পাঠিয়েছেন। গাড়ির মালিকানার বিষয়ে জানতে পারলে তাঁরা পরবর্তী ব্যবস্থা নেবেন।

অবশ্য পুলিশের আগে সংবাদকর্মীরা বিআরটিএতে গিয়ে গাড়িটির মালিকানার তথ্য জানতে পারেন। বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে, এ বছরের ১৮ মার্চ গাড়িটি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৭৬৫৫) বিআরটিএতে নিবন্ধিত হয়েছে। মালিক কামরুন্নাহার শিউলি। তাঁর স্বামী একরামুল করিম চৌধুরী।

দুর্ঘটনার পরদিন গতকাল বুধবার সকালে নিহত ব্যক্তির মরদেহটি শনাক্ত করেন তাঁর স্বজনেরা। নিহত ব্যক্তির নাম সেলিম ব্যাপারী (৪৬) বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন তাঁর জামাতা আরিফ ভূঁইয়া।

সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে আরিফ ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, নিহত সেলিম উত্তরখানের কুলারটেকে পরিবার নিয়ে থাকতেন। একটি আবাসন কোম্পানির মালিকের গাড়ি চালাতেন তিনি। মঙ্গলবার রাতে মালিককে বাসায় নামিয়ে গাড়ি রেখে তিনি উত্তরখানের বাসায় ফেরার জন্য রাস্তা পার হচ্ছিলেন। সেলিম এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা। ছেলেটি স্কুলে পড়ে। সেলিম তাঁর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন।

দুর্ঘটনার পর পিছু ধাওয়া
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মহাখালী ফ্লাইওভারে ওঠার মুখে এ দুর্ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ফ্লাইওভারে ওঠার মুখে লোকটি আরজতপাড়ার দিক থেকে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এ সময় একটি দ্রুতগতির জিপ তাঁকে ধাক্কা দিয়ে টেনেহিঁচড়ে বেশ কিছু দূর নিয়ে যায়। একপর্যায়ে লোকটির থেঁতলে যাওয়া দেহ রাস্তার ওপর পড়ে থাকে। গাড়িটি ফার্মগেটের দিকে চলে যায়। এ সময় গাড়ির পিছু ধাওয়া করেন এক মোটরসাইকেলচালক।

ওই মোটরসাইকেলচালক গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি গাড়িটির পিছু ধাওয়া করতে থাকেন। বেশ কিছু পথ ঘুরে গাড়িটি সংসদ ভবনের উল্টো দিকে ন্যাম ভবনে ঢুকে পড়ে। গাড়ির পিছু পিছু তিনিও ন্যাম ভবনে ঢুকে পড়েন। গাড়ি থেকে এক তরুণ বের হয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের দরজাগুলো বন্ধ করে দিতে বলেন। নিজেকে সাংসদের ছেলে দাবি করে ওই তরুণ মোটরসাইকেলচালককে বলেন, ‘তুমি অফ যাও, যত টাকা লাগে দিব।’ একপর্যায়ে ওই তরুণ এবং তাঁর সঙ্গীরা মোটরসাইকেলচালকের বুকে ঘুষি মারেন, মাথায় আঘাত করেন। পরে মোটরসাইকেলচালক ফিরে আসেন।

একই সময় শামীম আশরাফী নামের এক যুবকও গাড়িটির পিছু নিয়েছিলেন। শামীম গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, মোটরসাইকেলচালকের চিৎকার শুনে এক বন্ধুর গাড়িতে করে গাড়িটিকে অনুসরণ করেন তিনি। তাঁরা দেখতে পান, গাড়িটি ন্যাম ভবনের ভেতরে চলে যাচ্ছে। ওই মোটরসাইকেলচালকের সঙ্গে তাঁরাও ন্যাম ভবনে ঢুকে পড়েন।

শামীম বলেন, ন্যাম ভবনের ভেতরে গাড়িটি থেকে এক তরুণ নেমে বলেন, ‘এটা আমার এলাকা, কে আসবি আয়।’ তখন আশপাশ থেকে কয়েকজন লোক আসেন। এক যুবক এসে তরুণকে শাবাব বলে ডাকতে থাকেন। শামীম বলেন, ‘তাঁরা আমাদের গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করেন। তখন আমরা একটু সরে গিয়ে উপস্থিত লোকজন, দায়িত্বরত আনসার ও কেয়ারটেকারদের ঘটনা জানাই।’ তিনি বলেন, মোটরসাইকেলচালক গাড়ি ও চালকের ছবি তোলেন এবং ভিডিও করেন। কিন্তু হুমকি দিয়ে শাবাব তাঁর মুঠোফোন কেড়ে নেন। এ ঘটনার প্রমাণ ন্যাম ভবনের সিসি ক্যামেরায় আছে বলে তিনি জানান।

শামীম বলেন, ‘৯৯৯’ জরুরি নম্বরে যোগাযোগ করে ঘটনাটি জানালে তাঁদের কাফরুল থানায় যেতে বলা হয়। থানায় গেলে পুলিশ তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। তিনি বলেন, গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ার পর থেকে তাঁকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

ন্যাম ভবনের ৫ নম্বর ভবনের ৬০২ নম্বর ফ্ল্যাটটি সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরীর নামে বরাদ্দ। গতকাল রাতে ওই ভবনের নিরাপত্তাকর্মী নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ফ্ল্যাটটিতে সাংসদের পরিবারের সদস্যরা কেউ থাকেন না। তবে সাংসদের গাড়িচালক ও তাঁর এক গৃহপরিচারক থাকেন।

নিরাপত্তাকর্মী নজরুল বলেন, ‘মঙ্গলবার রাত ১১টার পর ভবনের পূর্ব দিকের পাম্প থেকে খাওয়ার জন্য পানি আনতে যাই। ফেরার পথে দেখি এমপির ছেলেসহ পাঁচ-ছয়টা পোলাপাইন দাঁড়ানো। দেখলাম সাদা জিপের সামনেটা পুরা ভচকাইয়া গেছে। তখন জিজ্ঞাসা করলাম কী হইছে। বলেন, অ্যাকসিডেন্ট কইরা আইছে। তারা এ নিয়া আলোচনা করতাছে। গাড়িটি এমপির ছেলে শাবাব চালাইয়া ন্যাম ভবনে ঢোকে।’ তিনি বলেন, শাবাব মাঝেমধ্যে এলেও ফ্ল্যাটটিতে থাকেন না।

জানতে চাইলে পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, গাড়িটি নোয়াখালীর সাংসদের স্ত্রী কামরুন্নাহারের। ঘটনাস্থলের আশপাশ থেকে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজে চালক শনাক্ত হওয়ার পর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে।