দুয়ার বন্ধ বিশ্বের চাপ বাংলাদেশকে

নৌকায় করে যাওয়া আশ্রয়প্রার্থীরা কোনো অবস্থায়ই আর অস্ট্রেলিয়ায় পা ফেলতে পারবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিল দেশটি ২০১৬ সালে। অস্ট্রেলিয়া ওই ঘোষণা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। দুই সপ্তাহ আগে সাগরে উদ্ধার করা ৬২৯ জন আশ্রয়প্রার্থী বহনকারী জাহাজ ভিড়তে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ইতালি ও মাল্টা। মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশগুলোতে যুদ্ধবিগ্রহ, অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপ অভিমুখী শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের স্রোত ঠেকানো ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য দেশগুলোর জন্য বড় রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠেছে।

একদিকে মিয়ানমার থেকে আসা ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় ও সুরক্ষা দেওয়া, অন্যদিকে বিদেশে অনিয়মিত হয়ে পড়া বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনা—দুই ধরনের চাপেই আছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে, ইউরোপে অনিয়মিত হয়ে পড়া প্রায় ৯৩ হাজার বাংলাদেশিকে ফেরত আনতে বাংলাদেশ গত বছর ইইউয়ের সঙ্গে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) সই করতে বাধ্য হয়েছে।

আশ্রয়প্রার্থী ও শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার মার্কিন ঐতিহ্যও হুমকিতে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে।

বিশ্ব শরণার্থী দিবস আজ ২০ জুন বুধবার। এ উপলক্ষে বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘জোরালো মানবিক সহায়তাদান ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র লাখো আশ্রয়প্রার্থী ও অন্যান্য আইনি ব্যবস্থার আওতায় সাময়িক সুরক্ষা পাওয়া মানুষকে ঠাঁই দিয়েছে। এর বাইরেও শরণার্থীদের পুনর্বাসন ও আশ্রয়দাতা হিসেবে অন্যতম উল্লেখযোগ্য দেশ যুক্তরাষ্ট্র।’ বার্নিকাটের ওই নিবন্ধ বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নীতি আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে শরণার্থী শিবির হতে দেবেন না। বার্নিকাট অবশ্য তাঁর নিবন্ধে লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক সহায়তার মূল বিষয় হচ্ছে শরণার্থী ও অন্যান্য বাস্তুচ্যুত লোকদের তাদের মাতৃভূমির কাছাকাছি কোনো দেশে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা যাতে একসময় তারা স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারে।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নিরাপত্তা বাহিনী ও তাদের দোসরদের ক্রমাগত নির্যাতন, জাতিগত নিধন, গণহত্যা এবং তা ঠেকাতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের ব্যর্থতায় গত কয়েক দশক ধরে লাখ লাখ শরণার্থীর বোঝা চেপেছে বাংলাদেশের ওপর। সর্ব শেষ গত বছরের ২৫ আগস্ট নতুন করে গণহত্যা শুরু হওয়ার পর আরো প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। বিশাল জনগোষ্ঠীর বোঝা সত্ত্বেও মানবিক কারণে ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা অনুযায়ী সীমান্ত খোলা রেখেছে বাংলাদেশ। কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘শরণার্থী’ ঘোষণা দিয়ে তাদের দায়িত্ব জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) কাছে হস্তান্তর করেনি। তবে শরণার্থী হিসেবে প্রাপ্য প্রায় সব সুবিধা রোহিঙ্গাদের দেওয়ার পাশাপাশি তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে বাংলাদেশ।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, রোহিঙ্গারা কবে ফিরবে বা আদৌ ফিরবে কি না তা কেউ জানে না। তারা যদি না ফেরে তাহলে নিঃসন্দেহে এ বোঝা বাংলাদেশের জন্য স্থায়ী রূপ নেবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো যখন আশ্রয়প্রার্থী বা শরণার্থীদের জন্য নিজেদের সীমান্তগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে অত্যন্ত মানবিকতা ও মহানুভবতা দেখিয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোও চেয়েছিল, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিক। এখন এ সমস্যার সমাধান করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব।

সম্প্রতি পাহাড়ধসে রোহিঙ্গার পাশাপাশি বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনা তুলে ধরে ওই কূটনীতিক বলেন, পশ্চিমাদের উচিত বাস্তবতার নিরিখে কথা বলা। পাহাড়ধসে যতজন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে তার কয়েক গুণ বেশি বাংলাদেশি নিহত হয়েছে।

পশ্চিমা সূত্রগুলো বলছে, রোহিঙ্গা সংকটের পর অনেক দেশ মানবিক সহায়তার প্রস্তাব দিলেও শরণার্থীর বোঝার ভাগ নেওয়ার প্রস্তাব তুলেছে কেবল কানাডা। দেশটির প্রধানমন্ত্রীর মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত রোহিঙ্গাদের কানাডায় আশ্রয় দেওয়ার সুপারিশ করেন। কানাডার জনগণের বড় অংশও একে সমর্থন করে। কিন্তু অতীত সময়ে সীমিত পরিসরে এ ধরনের শরণার্থী স্থানান্তর ইতিবাচক ফল আনেনি।

শরণার্থী ও শরণার্থীর মতো পরিস্থিতিতে থাকা লোকদের নিয়ে কাজ করা ইউএনএইচসিআর গতকাল মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১৭ সাল শেষে বিশ্বে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ব্যক্তির সংখ্যা ছয় কোটি ৮০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। যুদ্ধ, সহিংসতা ও নির্যাতনের কারণে বিশ্বব্যাপী জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি নতুন মাত্রা পেয়েছে। টানা পঞ্চমবারের মতো বাস্তুচ্যুতির হার বেড়েছে। কঙ্গোর সংকট, দক্ষিণ সুদানের যুদ্ধ এবং মিয়ানমার থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এতে মূলত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপো গ্র্যান্ডি বলেন, ‘আমরা একটা সন্ধিক্ষণে আছি, যেখানে বিশ্বব্যাপী জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনা সফলতার জন্য দরকার নতুন এবং অধিক সর্বাঙ্গীণ পন্থা, যাতে কোনো দেশ ও জনগোষ্ঠীকে এই সমস্যা একা মোকাবেলা করতে না হয়।’ এ ক্ষেত্রে আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘শরণার্থী পরিস্থিতিতে সাড়া দেওয়ার জন্য এরই মধ্যে ১৪টি দেশ একটি নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে এবং আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই শরণার্থীদের ওপর একটি নতুন গ্লোবাল কম্প্যাক্ট জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হবে।’

ইউএনএইচসিআর বলছে, বিশ্বে শুধু ২০১৭ সালেই বাস্তুচ্যুত হয়েছে এক কোটি ৬২ লাখ মানুষ। গড় হিসাবে তা দিনে সাড়ে ৪৪ হাজার এবং প্রতি দুই সেকেন্ডে একজন। বিশ্বে এখন শরণার্থীর সংখ্যা অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা থাইল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান।

জাতিসংঘ অবশ্য এর দ্রুত সমাধান দেখছে না। কারণ সমাধান চেষ্টা এখনো থেমে আছে খণ্ডকালীন সেবা বা সামগ্রী প্রদানের মধ্যে। যুদ্ধ ও হানাহানি যেখানে চলছে সেখানে শান্তির সুবাতাস খুব কমই বইছে। তৃতীয় দেশে স্থানান্তরের সুযোগ প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে।