তার সাংবাদিক মামা জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের কাছে ভাগ্নের একটি নাম চেয়েছিলেন। তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘নিনাদ’। আগে ‘সাফওয়ান’ লাগিয়ে নাম রাখা হলো ‘সাফওয়ান নিনাদ’। রাজধানীর খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়া এলাকায় আট বছরের নিনাদ খুন হলো। শনিবার ঈদের দিন দুপুর দেড়টায় লাশ মেলে কেক-পাউরুটি বিক্রির ভ্যানগাড়ির ভেতরে। তার গলায় শক্ত পলিথিন পেঁচিয়ে একটি হুকের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা ছিল। মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটেছে ঈদুল ফিতরের ছুটির সময়।
পরিবারের লোকজন জানাল, নিনাদকে মা-বাবাই গোসল করিয়ে দিতেন। কিন্তু ঈদের আগের দিন রাত ৯টার দিকে সে নিজেই গোসল করে। আগে মামার আনা আর্জেন্টিনা দলের জার্সি পরা ছিল। গোসলের পর লাল গেঞ্জি পরে খেলার কথা বলে বের হয় বাসা থেকে। সাড়ে ৯টার দিকে পরিবারের লোকজন কোথাও তাকে না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়। সাড়ে ১০টার দিকে ঝড়বৃষ্টি শুরু হলে উদ্বেগ আরো বেড়ে যায়। রাতভর খোঁজাখুঁজির পর সকাল থেকে চলে আবার খোঁজ। জিডি করা হয় খিলগাঁও থানায়। নিনাদের বাসা থেকে দু-তিনটি বাড়ি পড় একটি ফাঁকা জায়গায় দাঁড় করানো ছিল তিনটি তালাবদ্ধ ভ্যানগাড়ি। খোঁজার সময় পাশ দিয়ে গেলেও কারোরই মাথায় আসেনি ভেতরে লাশ থাকতে পারে। ঈদের দিন দুপুর দেড়টার দিকে এক শিশু ওই ভ্যানগাড়ির পাশে খেলা করছিল। ভ্যানগাড়ির দরজার ফাঁক দিয়ে তার চোখে পড়ে একটি পা। বিষয়টি সে বড়দের জানায়। সবাই গিয়ে তালা ভেঙে দেখে লাল গেঞ্জি পরা শিশু নিনাদকে গলায় শক্ত পলিথিন পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তখনো বাঁ পায়ে স্যান্ডেল পরা ছিল। ডান
পায়ের স্যান্ডেলটি পড়ে ছিল পাশেই। মুখ থেকে বের হচ্ছিল রক্ত।
নিনাদের মামা একটি জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক এস এম মুন্না জানান, ২০১৪ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা হচ্ছিল, তখন নিনাদের বয়স ছিল চার বছর। আর্জেন্টিনার খেলার দিন সেও দলটির জার্সি চায়। তখন থেকেই মুন্না চিন্তা করে রাখেন পরের বিশ্বকাপে তিনি প্রিয় ভাগ্নেকে আর্জেন্টিনার জার্সি কিনে দেবেন। গত মঙ্গলবার তিনি গুলিস্তান গিয়ে আর্জেন্টিনার কয়েকটি জার্সি কিনে আনেন। সেই জার্সি পরে উল্লসিত নিনাদ মামার সঙ্গে শুয়ে-বসে ছবিও তোলে। সেই ছবি ফেসবুকে আপলোড করেন মুন্না।
নিনাদের বাবা স্বপন বেপারী কান্নাজড়িত কণ্ঠে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কে হত্যা করল আমার নিষ্পাপ ছেলেটিকে? আমি তার হত্যাকারীদের বিচার চাই।’
গতকাল বিকেলে এলাকাটিতে গিয়ে দেখা গেছে থমথমে অবস্থা। জানা যায়, মেরাদিয়ার যে বাড়িটিতে নিনাদকে নিয়ে তার মা-বাবা থাকছেন তার জমি নিয়ে নিনাদের মা সানিয়া আক্তার ও মামাদের মধ্যে গণ্ডগোল রয়েছে। পাঁচ কাঠা জমিতে তাঁরা বাড়িও তুলেছেন। সেই গণ্ডগোলের সূত্রে এ ঘটনা ঘটেছে কি না তা তলিয়ে দেখছে পুলিশ। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ঘটনা দেখে ধারণা করা হচ্ছে, এ হত্যাকাণ্ডে একজন নয়, কয়েকজন জড়িত। শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে অন্য কোথাও। লাশ গুমের জন্য ভ্যানগাড়িতে ঢুকিয়ে রাখা হয়।
এলাকাবাসী জানায়, যে ভ্যানগাড়িতে নিনাদের লাশ পাওয়া গেছে তার মালিক গিয়াস উদ্দিন বলেই তারা জানে। গিয়াস উদ্দিনের ছয়তলা বাড়িটি নিনাদদের বাড়ির কাছেই। বাড়িটিতে গিয়ে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ভাড়াটিয়া গ্রামের বাড়ি চলে গেছে ঈদে। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় গিয়াস উদ্দিনকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখায়। তবে গিয়াস উদ্দিনের দাবি ভ্যানগাড়িগুলো তাঁর নয়, তাঁর ছোট ভাই নাজিম উদ্দিনের। তাঁর ভাইয়ের নাজিম এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান আছে। সেটা থেকে কোকা-কোলা ও ড্যানিশ মিল্ক সরবরাহ করা হয়। গিয়াস উদ্দিন বলেন, ঈদের আগে তাঁর ভাই গ্রামের বাড়ি গেছে। ঈদের আগের রাতে দুটি ভ্যানগাড়ির চালক রানা ও আলাউদ্দিন বারেকের প্লটে নিয়ে রাখে। রানা বাড়ি চলে গেছে, আলাউদ্দিন কোথায় আছে তিনি জানেন না। তিনি তাঁর ভাই নাজিম উদ্দিনের যে ফোন নম্বর দেন সেটিতে ফোন করে বন্ধ পাওয়া যায়। এলাকাবাসী জানায়, ভ্যানগাড়িতে যে তালাটি পাওয়া গেছে সেটি ছিল নতুন।
খিলগাঁও থানার ওসি মশিউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সব দিক মাথায় নিয়ে মামলাটি তদন্ত করছি। শিশুটির মামাদের সঙ্গে জমাজমি নিয়ে গণ্ডগোল রয়েছে। এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া খেলাধুলা নিয়ে কারো সঙ্গে কোনো গণ্ডগোল ছিল কি না এসব বিষয়েও দেখছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের কয়েকটি টিম কাজ করছে।’
গৃহবধূ ‘হত্যা’ : এদিকে যাত্রাবাড়ীতে স্বামীর মারধরের পর আসমা আক্তার শিমু (৩২) নামে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। গত শুক্রবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর নিহতের স্বামী আবদুল মাজেদ রাসেল পলাতক রয়েছেন। গতকাল এ খবর লেখা পর্যন্ত তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, ওই দিন দুপুর আড়াইটার দিকে রাসেলের সঙ্গে শিমুর ঝগড়া হয়। পরে রাসেল তাঁকে বেধড়ক মারধর করেন। এতে শিমু অসুস্থ হয়ে পড়লে রাসেলের পরিবারের লোকজন প্রথমে শিমুকে যাত্রাবাড়ীর একটি স্থানীয় ক্লিনিকে নিয়ে যায়। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বিকেলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ খবর পেয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়।