ভোগান্তি সঙ্গী করে বাড়ি ফেরা

কাঠফাটা রোদ, ভাপসা গরম আবার মুষলধারে বৃষ্টিসহ নানা দুর্ভোগ-ভোগান্তিকে সঙ্গী করেই ঘরমুখো লাখো মানুষ ঢাকা ছাড়ছেন। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার অদম্য বাসনায় কোনো ভোগান্তি, শঙ্কা তাদের থামাতে পারেনি। শবে কদরের ছুটির পর এক দিন সরকারি অফিস-আদালত খোলা—অনেকেই সেদিনের ছুটি নিয়ে আগেভাগে বাড়িমুখো হয়েছেন। যারা ছুটি নেননি তারাও শেষ মুহূর্তের দুর্ভোগ এড়াতে স্ত্রী-সন্তানদের পাঠিয়ে দিয়েছেন। ফলে গতকাল ভোর থেকেই ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষজনের উপচে পড়া ভিড় জমে ওঠে রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল ও লঞ্চঘাটে।

কমলাপুর রেলস্টেশনের ভেতরে-বাইরে বাড়িমুখো মানুষের ভিড়ে তিল ধারণেরও ঠাঁই ছিল না। কয়েক মিনিট পরপর স্টেশনের মাইকে ট্রেন পৌঁছানোর ঘোষণা দিতেই কয়েক শ মানুষের ছোটাছুটি চলে প্লাটফর্মে যাওয়ার। তখন হইচই, চিৎকার, কোলাহলে অন্য রকম এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। দিনের বেলাতেই হাজার হাজার যাত্রী নিয়ে একে একে ৪৩টি ট্রেন কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে যায়। তবু যেন স্টেশনে লোকের ভিড় আরও বাড়তেই থাকে। অভিন্ন পরিস্থিতি ছিল রাজধানীর প্রতিটি বাস টার্মিনাল ও বিশেষ কোচস্ট্যান্ডগুলোতে। প্রতিটি কোচ কাউন্টারের সামনে থেকে যাত্রীবোঝাই একটি কোচ ছেড়ে যেতে না যেতেই আরও পাঁচ/সাতটি গাড়ির যাত্রীকে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। ঘর থেকে বেরোতেই রিকশা-সিএনজির মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া, পথে পথে ঈদ বখশিশের চাঁদাবাজিসহ নানা ভোগান্তির পর বাস টার্মিনাল কিংবা কোচ কাউন্টারে পৌঁছাতে পেরেই অনেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। একইভাবে বিকাল থেকেই যাত্রীদের ঠাসা ভিড় জমে ওঠে সদরঘাট নৌবন্দরে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জনপদের হাজার হাজার যাত্রীর উপচে পড়া ভিড়ে দমবন্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হয় সদরঘাট জুড়ে। ভিড় এড়াতে অনেক যাত্রীকে মহিলা ও শিশুদের নিয়ে আশপাশের মার্কেট ও দোকানের কোণে অপেক্ষমাণ থাকতে দেখা যায়।

দুপুরের পরপরই টার্মিনালের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া মানুষজন তীব্র গরমে চরম অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়েন। কিন্তু প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতে তাদের অনেককেই আবার কাকভেজা অবস্থায় টার্মিনালে পৌঁছাতে হয়। মুষলধারে বৃষ্টিতে নারী ও শিশুদের নিয়ে অনেকে চরম বিপাকে পড়েন। ঘরমুখো যাত্রীদের ভিড়ে রাজধানীর স্টেশন, টার্মিনাল ও লঞ্চঘাটমুখে ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই অবস্থা। সর্বত্রই যানবাহনের ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক গুণ বেশি যাত্রীর অবস্থান চোখে পড়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি সড়ক-মহাসড়কে ছিল বিরক্তিকর যানজট। টার্মিনালে অপেক্ষার পর যানবাহনে উঠতে পারলেও পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে কাটাতে হলে জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে। আর অতিরিক্ত যাত্রী বহনে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কাঁধে নিয়েই পরিবহনগুলো নেমে পড়ছে অনিশ্চিত যাত্রাপথে। তবে ট্রেনযাত্রা ঝুঁকিমুক্ত রাখতে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্টেশনের রেলওয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের বিশেষ উদ্যোগ নেওয়াসহ তৎপর থাকতে দেখা গেছে। সেখানে নিরাপত্তা ইনচার্জ মজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রতিটি ট্রেনের ছাদ ও ইঞ্জিনবগিতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে যাতায়াতকারী যাত্রীদের নামিয়ে বগির ভেতর ঢুকিয়ে দেন। সড়ক-মহাসড়কে দুর্ভোগের অন্ত নেই, লঞ্চযাত্রায় রয়েছে সীমাহীন ঝুঁকি, সবকিছুকে তুচ্ছ করে ছুটছে মানুষ ছুটছে। যে কোনো উপায়ে বাড়ি তাদের যেতেই হবে। বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছানো কোচ-চালকরা জানিয়েছেন, ঢাকার সঙ্গে দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে যানজটের মাত্রা। চার লেনের রোড হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক যানজট মুক্ত রাখা যাচ্ছে না। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে চার লেনের বেশ কিছু অংশের কাজ শেষ হওয়ায় এর সুবিধা পাওয়া গেলেও কয়েকটি জায়গার যানজট নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ডিভাইডারগুলোর কাজ এখনো শেষ হয়নি। সেসব স্থানেই হরদম যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। কোচ-চালকরা জানিয়েছেন, উত্তরবঙ্গগামী যাত্রীদের যাত্রা নির্বিঘ্ন রাখতে সার্বক্ষণিক মহাসড়ক ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত পুলিশ ও আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। বিশেষ করে গাজীপুর জেলা ও টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসন যমুনা বঙ্গবন্ধু সেতুমুখী মহাসড়কে যানবাহন চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে রাত-দিন পরিশ্রম করছে। কিন্তু চার লেনের নতুন সড়কের কয়েকটি স্থানের প্রতিবন্ধকতায় গাড়ি চলাচলে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন চালকরা।

অন্যদিকে মেঘনা সেতুর টোলপ্লাজায় অব্যবস্থাপনার কারণে তীব্র যানজটে পড়ছেন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রীরা। বিশেষ করে দাউদকান্দির মেঘনা সেতুর টোলপ্লাজায় অব্যবস্থাপনা চোখে পড়ার মতো। খালি ট্রাককেও পাঠানো হচ্ছে ওজন স্কেলে। এতেই আরও দীর্ঘ হচ্ছে যানজট। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ছয় লেনে উন্নয়নের কাজ চলায় বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। আর ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে দীর্ঘ পথে সড়কের পাশের মাটি সরে যাওয়ায় রয়েছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। এসব মাথায় নিয়েই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাসমূহের লাখ লাখ মানুষ বাস-মিনিবাসে বাড়িমুখো হয়েছেন।

লঞ্চের সারেংরা জানিয়েছেন, নৌরুটে আবহাওয়া প্রতিকূল থাকায় দক্ষিণবঙ্গগামী যাত্রীদের নানা রকম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। আছে যাত্রাপথের বিপত্শঙ্কা। ঈদযাত্রার প্রতিটি লঞ্চই ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি যাত্রী নিয়ে গন্তব্যপথে রওনা দিয়েছে। শেকড়ের টানে গ্রামে ছোটা নগরবাসীর কারও সঙ্গে বিশাল পরিবার-পরিজন, কেউবা একাকী। ভাঙাচোরা সড়কে পদে পদে ভোগান্তি, যানজট, পরিবহন সংকট ও বাড়তি ভাড়াসহ পথের নানা ভোগান্তি তুচ্ছ করেই পথে নেমেছেন তারা। ঈদের আর মাত্র দুই কি তিন দিন বাকি। তাই আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট করতে চাইছে না কেউই।