মারাত্মক যৌনরোগ সিফিলিস: কারণ-লক্ষণ-প্রতিকার

সিফিলিস স্পিরোসেত ব্যাকটেরিয়া ট্রেপোনেমা পেলিডাম উপজাত পেলিডাম দ্বারা সৃষ্ট একটি যৌনবাহিত রোগ। সংক্রমণের প্রাথমিক পথ যৌন সংস্পর্শ;তাছাড়াও রক্ত পরিসঞ্চালন, চুম্বন,চামড়ার আঘাতপ্রাপ্তি এবং গর্ভাবস্থায় বা জন্মের সময় মায়ের কাছ থেকে ভ্রূণে সংক্রমিত হতে পারে।

সিফিলিসের লক্ষণ এবং উপসর্গের উপর নির্ভর করে একে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যায় (প্রাথমিক, দ্বিতীয়, সুপ্ত, এবং তৃতীয় পর্যায়)। প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণত একটি একক যৌনব্যাধিজনিত ক্ষত (একটি দৃঢ়, যন্ত্রণাহীন, চুলকানিবিহীন চামড়ার ক্ষত), দ্বিতীয় পর্যায়ের সিফিলিসে একটি বিকীর্ণ ফুসকুড়ি যা ঘন ঘন হাতের তালুতে এবং পায়ের পাতার নিচের অংশে, সুপ্ত সিফিলিসে সামান্য বা কোনো লক্ষণবিহীন অবস্থা, তৃতীয় পর্যায়ের সিফিলিসে গুমাস, স্নায়বিক বা হৃৎপিণ্ডঘটিত উপসর্গ দেখতে পাওয়া যায়।

যাইহোক, এর ঘন ঘন এটিপিকাল উপস্থাপনা কারণে তা মহান অনুকারক হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেছে।সিফিলিস স্পিরোসেত ব্যাকটেরিয়া ট্রেপোনেমা পেলিডাম উপজাত পেলিডাম দ্বারা সৃষ্ট একটি যৌনবাহিত রোগ। সংক্রমণের প্রাথমিক পথ যৌনসংস্পর্শ।তাছাড়াও রক্ত পরিসঞ্চালন, চুম্বন,চামড়ার আঘাতপ্রাপ্তি এবং গর্ভাবস্থায় বা জন্মের সময় মায়ের কাছ থেকে ভ্রূণে সংক্রমিত হতে পারে।

এই রোগ দুইভাবে আত্মপ্রকাশ করে থাকে- বিস্তীর্ণ প্রদাহ এবং স্থানীয় প্রদাহ। বিস্তীর্ণ প্রদাহতে সাধারণত নিম্নলিখিত অংগসমূহ আক্রান্ত হয়ে থাকে। স্থানীয় প্রদাহতে ধরনের প্রদাহে সুস্পষ্ট ভাবে রেখায়িত ক্ষত সৃষ্টি হয়। যা হলদে এবং রাবারের মত শক্ত হয়। এক রকম খাঁজ কাটা ক্ষত সৃষ্টি হয় যার মাঝে এক, এক ধরনের চামড়ার মত দেখায়। যকৃৎ, শুক্রাশয়, টিবিয়া, আলনা, দাঁতের চোয়ালের হাড়ে সাধারণত আক্রান্ত হয়ে থাকে। রোগের উৎস হচ্ছে, ক্ষত বা কাটা চর্ম এবং শ্লেষ্মা ঝিল্লী, লালা, বীর্য, Cervacal এবং যোনীর ক্ষরণ, এবং রক্ত।

রোগের কারণ ও বিস্তারঃ
এ রোগের জীবাণু, ইহা যৌনসংগমের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যৌনসংগমের দরুন যৌন অঙ্গের চামড়ায় সামান্য ক্ষত হলে ঐ স্থানে জীবাণু কর্তৃক আক্রান্ত হতে পারে। কারো কারো বংশে থাকলে তার সন্তানের হতে পারে।শরীরের যেকোনো স্থানের ক্ষত জায়গা দিয়েও এই জীবাণু ঢুকে রোগ সৃষ্টি করে। চুম্বনের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। যে সকল পতিতার বা নারীদের মধ্যে এ জীবাণু আছে তাদের সাথে মুক্তভাবে সহবাস করলে এ রোগ হয়। সেবিকা, দাই, দন্ত চিকিৎসকের হাতের আঙ্গুলের দ্বারাও এ রোগ হয়ে থাকে। রক্ত আদান প্রদানের মাধ্যমে এ রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত মায়ের গর্ভের শিশুর ও এ রোগ হয়ে থাকে।

রোগের লক্ষণ:
*জীবাণুযুক্ত যোনিতে সহবাসের ফলে লিঙ্গের মাথায় বা উহার গায়ে ছোট ছোট ফুসকুড়ি ওঠে এবং ঘায়ের সৃষ্টি হয়। স্ত্রী লোকের বেলায় এ ঘা ভালভার, লাবিয়া মাইনোরা, কারভিক্স এ আবির্ভূত হয়। প্রাথমিক অবস্থায় যে ক্ষতটি হয় তা শক্ত থাকে। চুম্বনের মাধ্যমে মুখে ও ঠোঁটে ঘা হয়। ক্ষত ২ থেকে ৩ দিন নরম থাকে ও পুঁজ নির্গত হয়। ঘা টির তলদেশ শক্ত হয় এবং সাথে কুঁচকিতে বেদনাহীন স্ফীত গোটা (lymph node) তৈরী হয়। কখনো একাধিক ঘা দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় এ ঘা দেখা যায় না। ১০ থেকে ১৫ দিন পর রোগীর বর্গীর চামড়া পাতলা হয়ে পেকে ওঠে। যেখানে যেখানে দেখা যায়ঃ- সাধারণত জননাঙ্গে দেখা যায়- লিঙ্গ মুন্ড, যোনিমুখ, জরায়ুমুখ ইত্যাদি। জননাঙ্গের বাইরে-ঠোঁট ও তালু, মুখ, স্তন এবং আঙ্গুল।

* প্রাথমিক ক্ষত প্রকাশের ২ থেকে ৩ বা ৪ মাসের পর দ্বিতীয় অবস্থা শুরু হয়। দুর্বল রোগীর ক্ষেত্রে অল্পদিনে এবং বলবান রোগীর ক্ষেত্রে দেরীতে প্রকাশ পায়।এ অবস্থায় রোগীদের নানা রকম রোগ হয়। চর্ম শ্লৈষ্মিক ঝিল্লী, চক্ষু, স্নায়ুমন্ডলী এবং দেহের অন্যান্য অংশে এ রোগের জীবাণু সঞ্চিত হয়। এসময় রোগীর সামান্য জ্বর, গলায় ব্যথা, নিস্তেজ ভাব, হাত ও পায়ে বেদনা, রক্তসল্পতা, শিরঃপীড়া ও ওজন হ্রাস পায়। চর্মে যে সমস্ত পিড়কা হয় তাতে কোন চুলকানী হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তা তামাটে বর্ণের হয়। মাস খানেক পর এ পিড়কা আপনা আপনি মিলে যায়। তখন এই পিড়কা হাত ও পায়ের তালুতে দেখা যায়। মুখের কিনারায়, মলদ্বারের কিনারায় এবং দেহের অন্যান্য ভিজাস্থানে আঁচলি জাতীয় দানা উৎপন্ন হয়। উহার নাম Condylomata lata. এভাবে দেড় বছর হতে ২ বছর কাল চলে। পরে আর তেমন কষ্ট হয় না। নারীদের ক্ষেত্রে লজ্জা বশত এ রোগ পুষে রাখলে যোনির মুখ বড় ও বিকৃত পিণ্ডাকৃতি হয়। অভ্যন্তর ভাগ হতে দুর্গন্ধময় ক্লেদ রস নির্গত হয়।

* এ অবস্থা অত্যন্ত কষ্টকর ও সাংঘাতিক। এ অবস্থা দ্বিতীয় অবস্থার সঙ্গে চলতে থাকে। কখনো দ্বিতীয় অবস্থার পর শূরু হয়। এ অবস্থার চর্মে, চর্মের নিম্ন ভাগে, মাংসে, অস্থি, মস্তিষ্ক, মুখ, পাকস্থলী, অন্ত্র, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস ইত্যাদি আক্রান্ত হয় এবং সিফিলিস এর গামা দেখা যায়। চামড়ায় আক্রান্ত হলে তা ক্ষত হয়ে ক্লেদ বের হয়। ক্ষত বৃদ্ধি পেতে থাকলে রোগীর মুখের তালুতে আক্রান্ত হয়। নাসারন্ধ্র ও শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। মস্তিষ্কে আক্রান্ত হলে শিরঃপীড়া, স্মৃতিলোপ, আর্ধাঙ্গিক রোগ দেখা যায়। যকৃৎ বড় হয়ে পেটে শোথ হয়। হাড়ে, অস্থি, সন্ধিতে সিফিলিস এর গামা দেখা যায়। অণ্ডকোষে গামা উৎপন্ন করে এবং উহাকে বেদনাহীন ভাবে স্ফীত করে তোলে।

*আধুনিক মতে, প্রাথমিক অবস্থা জীবাণু প্রবেশের ৭-৯০ দিনের মধ্যে Chancre উৎপন্ন হয়। Chancre এর বৈশিষ্ট্য হল, অনেক বেশি লাল, ব্যথাহীন, একটি ক্ষত হবে। অনির্ধারিত তল কিনারা বিশিষ্ট জলীয় পদার্থ নির্গত হয়। সাধারণত একাকি ভাল হয় তবে সেখানে গৌণ সংক্রমণহলে ব্যথা উৎপন্ন হয়।

*সাধারণত প্রাথমিক Chancre এর ৬-৮ সপ্তাহ পর শুরু হয়। সেক্ষেত্রে সাধারণ রোগ সমূহ যেমন-মাথাব্যথা সঙ্গে সামান্য জ্বর থাকে এবং অসস্তি বোধ হয়। সাধারণত ৪টি মৌলিক চিহ্ন দেখা যায়- Syphilistic Rash, সমস্ত শরীর হাত ও পায়ের তালু। এটা সাধারণত ফুসকুড়ির মত হয়। অনেক সময় ফুসকুড়িতে জল হয়। Condylomata Lata, আর্দ্র জায়গায় ফুসকুড়ি ওঠে। সাধারণত মলদ্বারের পাশে। Generalized Lymphadenopathy, সাধারণত লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাবে। Mucous Patches, মুখ, গলা ও যৌনাঙ্গের শ্লেষ্মা ঝিল্লীতে জেব্রার ন্যায় দাগ হয়।

* তৃতীয় অবস্থায় উপনিত হতে মূলত ১০ বছর/ তারো অধিক সময় লাগে। সেক্ষেত্রে নিম্নের লক্ষণ প্রকাশ পায়, চামড়া ও চামড়ার নিচের টিস্যু্‌, শ্লেষ্মা ঝিল্লী, হাড়, এক ধরনের বিকৃতিকর অবস্থা পরিলক্ষিত হয়ে তাকে গুম্মা বলে। প্রধান অঙ্গসমূহ আক্রান্ত হয় মূলত সিএনএস (নিউরো সিফিলিস), সিভিএস (কার্ডিওভাসকুলার সিফিলিস)।

প্রতিরোধক মূলক চিকিৎসাঃ প্রতিরোধক মূলক চিকিৎসার হ্মেত্রে, যৌনবাহিত রোগের প্রতি আরো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যৌনসঙ্গী বাছাই করতে হবে যাদের যৌন রোগ নেই। যাদের যৌন রোগ আছে তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত চিকিৎসা করতে হবে। যার স্বামী বা স্ত্রী নিজেরা ছাড়াও অন্য লোকের সাথে যৌন সঙ্গম করে তাদের রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে হবে। যারা গর্ভবতী , যে সব নারী বার বার স্বামী থেকে পৃথক হয়, পতিতা, রক্তদাতা, শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক, সেনাবাহিনী, পুলিশ, যাযাবর, রেস্টুরেন্ট, হোটেল কর্মকর্তা, কর্মচারী এ সকল শ্রেণীর লোকজনদের নিয়মিত ভিডিআরএল টেস্ট করতে হবে। যৌনসংগমের পূর্বে কনডম, যোনীর মধ্যবর্তী জেলিয়াস এন্ড ক্রীম ব্যবহার করতে হবে ও সঙ্গমের পর যৌনাঙ্গ পরিষ্কার করতে হবে।

লোকজনদের অবশ্যই সিফিলিসের মহামারী ও মারাত্মকতা সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করতে হবে। পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে উপদেশ দিতে হবে। ব্যাশ্যাপনা বন্ধ করা অথবা এর উপর কঠোর আইন প্রণয়ন করা অথবা শিক্ষার মাধ্যমে, চাকরির দ্বারা উচ্ছেদ করতে হবে। যৌন উত্তেজনা মূলক সাহিত্য, অশ্লীল ছবি, বই ইত্যাদি বিক্রি নিষেধ করতে হবে। বিয়ে বন্ধন ও বিয়ের পূর্বে পরীক্ষা করতে হবে। স্বামী স্ত্রী অথবা যৌন সঙ্গীদের ভিডি ক্লিনিংয়ে যাওয়া এবং শিক্ষা লাভ করা উচিত। রোগের চিকিৎসা ও দেখাশোনা সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া।

বংশগত সিফিলিসের প্রতিরোধ হ্মেত্রে, গর্ভের প্রথম তিন মাসের সকল গর্ভবতী নারীর পরীক্ষা ও ডাব্লিউআর টেস্ট করতে হবে সিফিলিস নির্ণয়ের জন্য। যদি কোনো নারীর সিফিলিস ধরা পড়ে তাহলে তার তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা করতে হবে। জন্মের পর নবজাতক কে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরীক্ষা করতে হবে এবং রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসা করতে হবে। এ রোগের মারাত্মকতা সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে।